বিদ্যুৎ-জ্বালানি কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে সৌদি আরব। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো বিষয়ে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ- সৌদি আরব। শীঘ্রই এ বিষয়ে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই করতে যাচ্ছে দুই দেশ। শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের অনুষ্ঠানে সফররত সৌদি বাণিজ্যমন্ত্রী ড. মাজিদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাসাবির সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন। ওই সময় সৌদি আরবের পক্ষ থেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়।
এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। ওই সময় বেসরকারি খাতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে ৩টি সমঝোতা স্মারক সই করে সৌদি সরকার। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার টু সরকার সমঝোতা স্মারকে সই করতে যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপ মুনশি সাংবাদিকদের জানান, কোন কোন খাতে সৌদি আরবের বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে, সে বিষয়ে সৌদির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য ভালো খবর- সৌদি এ খাতে বিনিয়োগ করতে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য খাতেও তারা বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আশা করি দুই দেশের বাণিজ্য এগিয়ে যাবে। সৌদি আরব এখনই এসব খাতে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করতে পারে। উল্লেখ্য, সৌদি আরব ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিজনেস সামিটে অংশগ্রহণ করে সৌদি প্রতিনিধি দল সেই প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ দ্রুত এ দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা যায়। বিজনেস সামিটে অংশ নিয়ে সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রী ড. মাজিদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাসাবি বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সৌদি আরব বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করবে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ও রংপুর চিনিকলকে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে রূপান্তর এবং আরবি ভাষা শিখিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই করা হবে। এদিকে যৌথ মালিকানায় সৌদি আরবে প্রস্তাবিত ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপনের বিষয়ে দেশ সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
শনিবার বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের ফাঁকে সৌদির বাণিজ্যমন্ত্রী ড. মাজিদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাসাবির সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠক শেষে সার কারখানা স্থাপনের বিষয়ে দেশ সম্মতির কথা জানান মন্ত্রী। ড. মোমেন বলেন, আমরা চাচ্ছি সার কারখানা সেখানে (সৌদিতে) করব, তারা আমাদের বেনিফিট (লাভ) দেবে। ওখানে (সৌদ) সস্তায় সার তৈরি করা যায়। তারা তাতে রাজি হয়েছে। সৌদির বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে মোমেন বলেন, বলেছেন, কথাবার্তা না, আমরা কাজ করতে চাই। সৌদি এখানে কয়েক প্রজেক্ট নিয়েছে, এর মধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। তারা পতেঙ্গার এক প্রজেক্টে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা তাদের একটা স্পেশাল ইকোনো জোন দিয়েছি। তারা জানালেন, ওখানে কাজ শুরু করবেন। এটা চট্টগ্রামে।
এ ছাড়া এনার্জি ও পোর্ট সেক্টরে সৌদ বিনিয়োগ করতে চায় জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা এনার্জি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়, বন্দর খাতে করতে চায়। তারা এয়ারপোর্টে ইনভেস্ট করতে চায়। বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নেওয়া এবং আইটি সেক্টরের লোকবল নিয়োগ দিতে সৌদির বাণিজ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন বলেও জানান মোমেন। বাংলাদেশে বিদেশীদের বিনিয়োগে আগ্রহ থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিয়ে আপত্তি রয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে।
আস্তে আস্তে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী খুব শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জটিলতার জন্য যেন কোনো প্রজেক্ট বন্ধ না হয়, দেরি না হয়। বিদেশী অনেক দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী আরও জানান, সৌদি আরব বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র এবং দীর্ঘদিনের বৃহৎ ব্যবসায়িক ও উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, বেকারি আইটেম, ভেজিটেবল, জুস, জুট পণ্যসহ বেশকিছু পণ্য রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনশক্তি সৌদি আরবে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ সৌদি আরব থেকে পেট্রোলিয়াম তেল, গ্যাস, ফার্টিলাইজার, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে।
সামিটে তিন বিষয়ে সমঝোতা হবে সৌদির সঙ্গে ॥ সৌদি আরবের সঙ্গে এবারের সামিটে তিন বিষয়ে সমঝোতা হবে সরকার টু সরকার পর্যায়ে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, রংপুর চিনিকলের জায়গাটিকে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে রূপান্তর করে সেখানে গ্যাসলাইন সংযোগে বিনিয়োগ করবে সৌদি এবং আরবি ভাষা শিখিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব এ বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে সৌদি আরবের কোম্পানি অ্যাকোয়া। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পর এবার এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস)-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগে দেশে তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাাপন করা হবে। এ ছাড়া দেশের সিমেন্ট, জ্বালানি, স্বাস্থ্যা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তথ্যমতে, সৌদি আরবের সঙ্গে সরকারের ১৭৬ কোটি ডলারের চুক্তি ইতোমধ্যে সই হয়েছে। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ দিয়ে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের আধুনিকায়ন প্রকল্প বাস্তববায়ন, ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটকে নতুন করে সাজানো হবে। কাজটি করবে সৌদি প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন। এ ছাড়া বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের আওতায় ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিকে নতুন করে সাজানো হবে। এখানেও বিনিয়োগ করছে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন।
তারা লাফার্জহোলসিমের মতো ভারতের মেঘালয় থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কনভেয়ার ভেল্ট তৈরি করবে। নতুন যে প্রতিষ্ঠান কাজটি করবে, তার নাম দেওয়া হয়েছে সৌদি-বাংলা সিমেন্ট কারখানা। এর মাধ্যমে দেশেই সিমেন্টের ক্লিঙ্কার পাওয়া যাবে।
চীন এবং ভুটানের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাংলাদেশ সফররত, চীন ও ভুটানের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। এ বিষয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র চীন ও ভুটান। বাংলাদেশে চীনের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের বিনিয়োগকারীগণ আরও বেশি করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের এনার্জি, কৃষি, ফুড প্রসেসিং এবং অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে আরও বিনিয়োগ করবে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া ভুটান বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। এ জন্য নৌপথ এবং স্থলবন্দরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে দ্রুত বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে চায়। বিজনেস সামিটে যোগদানকারী চায়না কাউন্সিল ফর দি প্রমোশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড জাং শাওগাং-এর সঙ্গে মতবিনিময় করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এ সময় চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চীনের চতুর্থ বৃহৎ ব্যবসায়িক অংশীদার। বাংলাদেশের এনার্জি, এগ্রোবেজ ইন্ডাস্ট্রি, ফুড প্রসেসিং এবং অবকাঠামো খাতে আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
চীনের বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ভুটানের শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী কার্মা দর্জির সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় ভুটানের মন্ত্রী বলেন, ভুটান বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। এ জন্য উভয় দেশের নৌপথ সচল এবং ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বন্দরের সমস্যাগুলো দূর করার আহ্বান জানান।