আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। তবে আসন্ন নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল বিএনপি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করে একাধিক বক্তব্য দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। সেজন্য রাজনৈতিক মিত্রদের ধরে রাখা, কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়ন ও সংগঠন শক্তিশালী করার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের আরও জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তারেক রহমান। এসব বিষয় সামনে রেখে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সংগঠনকে গুছিয়ে আনার বিষয়টিও চলমান।
আগামী সংসদ নির্বাচন যেন দেড় বছরের মধ্যে হয় সেজন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
এদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে প্রশ্ন উঠেছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কি আসলেই কঠিন? বিএনপির শীর্ষ নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত প্রায় দেড় দশকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশাসনসহ সর্বস্তরে দলীয়করণ ও আওয়ামী লীগ টানা তিনবার একতরফা নির্বাচন করায় নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থাও তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া ১/১১ সময়ের অভিজ্ঞতাও বিএনপির জন্য সুখকর নয়। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে তাদের মনোভাব বুঝেশুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। সে কারণেই আগামী নির্বাচনকে কঠিন হিসেবে দেখছে বিএনপি।
জানা যায়, গত সোমবার ময়মনসিংহে বিএনপির বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমার ৩০-৩৫ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বলছে—আগামী নির্বাচন হবে জাতির জন্য কঠিন এক নির্বাচন। কারণ মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়েছে। তাই আমরা যদি কোনো ভুল করে থাকি তাহলে নিজেদের সংশোধন করতে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন আমরা এখনই ক্ষমতায় চলে গেছি, কিন্তু তা নয়। ক্ষমতায় যেতে হলে জনসমর্থন প্রয়োজন। জনগণের সমর্থন আমাদের আদায় করতে হবে। জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে। তাদের আস্থা ধরে রাখতে হবে। নেতাদের চাল-চলনে মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে তারেক রহমানের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান গতকাল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ ছিল বিগত সরকারের আমলে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে আসীন থেকে যারা নির্বাচনকে কলুষিত করেছে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া। কিন্তু সেটি না করে তাদের শক্ত অবস্থান সম্পর্কে বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমে সংস্কার, এরপর নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে আলোচনা চলছে, এটা কোনো বাস্তবসম্মত কথা নয়। সংস্কারের নামে অনির্দিষ্টকালের জন্য জনগণের ভোটাধিকার লঙ্ঘন করা অযৌক্তিক। অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ভোটাধিকার, কথা বলার অধিকার তথা মৌলিক অধিকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে দেবে—এর মাধ্যমে দেশে জনগণের সরকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ড. মঈন খান বলেন, কবে কখন কীভাবে নির্বাচন হবে সেটা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। সে কারণেই আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বারবার বলেছি অতিদ্রুত সংস্কারগুলো শেষ করতে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সংস্কার চলছে। আমি আগে সংস্কার করব এরপর নির্বাচন দেব—এটা কোনো বাস্তবসম্মত কথা হতে পারে না। আজকে যা সংস্কার করা হবে তা নিয়ে আগামীকাল পুনরায় সংস্কারের প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই সংস্কার এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া সমানতালে চলতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোকে নির্বাচন বলে না। তাই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার অত্যাবশ্যকীয় সেগুলোর ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সংস্কার আনাটা অত্যাবশ্যকীয়। নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হচ্ছে চারজন। ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার এই পদগুলোতে যেভাবে দলীয়করণ করেছে তাতে করে এ প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ ছিল বিগত সরকারের আমলে এসব পদে থেকে যারা নির্বাচনকে কলুষিত করেছে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, তারা এ কাজটি সময়মতো করতে পারেনি। আমি আশা করি, এই গাফিলতির খেসারত তাদের যেন দিতে না হয়। এখনো সময় রয়েছে।
৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এর পর থেকেই এ সরকারের মেয়াদ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-বিশ্লেষণ চলতে থাকে। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই মৌলিক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়ার কথা বলে আসছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ গত ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেক কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেল লাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে। নির্বাচনের আয়োজন চলাকালীন কিছু সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে।’ তবে তিনি নির্বাচনের বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছুই বলেননি। সম্প্রতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি পৃথক কমিশন গঠন করেছে সরকার এবং কমিশনগুলোর কার্যক্রমও দৃশ্যমান।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, প্রকাশ্য শত্রুকে চেনা যায়। কিন্তু অদৃশ্য শত্রুকে চেনা মুশকিল। ১/১১টা এসেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তি বা বিএনপিকে ঠেকানোর জন্য এবং সেটির ভেতর থেকেই আঘাতটা এসেছিল। মঈন-ফখরুদ্দিনরাই ষড়যন্ত্র করে তাদের সামনে এনেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এখানে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে। দেশি-বিদেশি শক্তি বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে গত ১০-১৫ বছরে।
আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য কি সামগ্রিকভাবে কঠিন? এই প্রশ্নের জবাবে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নির্বাচনটা সামগ্রিকভাবেই কঠিন। বিএনপি যেখানে ভালো করত, এমন সোয়া একশ সংসদীয় আসন তারা তছনছ করেছে। সেজন্যই মনে হয়েছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। ভালো নির্বাচন বললেই হয়ে যাবে, এটা ঠিক না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ক্ষুব্ধ অভিজ্ঞতায় বুঝি যে, ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সমগ্র রাজনীতির যে অবস্থা, তাতে অনেক দৃশ্য পাল্টে যাচ্ছে। সে কারণে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কিন্তু সাক্ষাৎও করছেন। তারা দলের অনুভূতি এবং করণীয় সম্পর্কে অবগত করছেন। সুতরাং আমাদের দলের চেয়ারম্যান যা বলবেন, সেটি দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণ বলেই আমি মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, একটা লম্বা সময় ধরে বিএনপি ক্ষমতায় নেই। প্রশাসনিক পুনর্গঠনে বিএনপির অংশগ্রহণ সীমিত। তাদের হাতে সময় একদম সামান্য। বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে কতটুকু স্বাধীন করা যায়, তার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির ক্ষমতায় আসা। তিনি বলেন, বিএনপি যেহেতু ক্ষমতার জন্য সম্ভাবনায় ছিল, সেজন্য তাদের ওপরই নির্যাতন নিপীড়ন বেশি হয়েছে। তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যারাই ক্ষতিগ্রস্ত, তারাই জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারের নিরপেক্ষতা কাজে লাগিয়ে জনগণকে মোটিভেট করা অবশ্যই বিএনপির জন্য কঠিন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদীরা ক্ষমতায় থাকা অর্থাৎ প্রশাসনিক পূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া বিএনপির জন্য নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং।