সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২৮ পূর্বাহ্ন

ট্রাউজারের সিংহভাগই সরবরাহ করছে বাংলাদেশ

রিপোর্টারের নাম / ২৫২ বার দেখা হয়েছে
আপডেট করা হয়েছে সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩, ১:৪৬ অপরাহ্ন

বিশ্ববাজারে বছরে ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের ট্রাউজার আমদানি হয়। যার সিংহভাগই সরবরাহ করছে বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্প কারখানাগুলো। আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) সংকলিত পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানিয়েছে পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

১৮ মার্চ বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া শীর্ষ পোশাকপণ্যের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ  সেখানে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যসূত্রে  ২০২০-২২ সাল পর্যন্ত শীর্ষ ২০ পোশাকপণ্যের রফতানিচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি আইটিসির সংকলিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে ২০২১ সালে শীর্ষ ২০ পণ্যের আমদানি ও এসব পণ্যে বাংলাদেশের শেয়ার বা অংশ প্রকাশ করা হয়েছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে পুরুষের (মেনজ বয়েজ) কটন ওভেন ট্রাউজার আমদানি হয়েছে ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। বিশ্বে পণ্যটি আমদানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। একই বছর নারীর (ওমেনস/গার্লস) কটন ওভেন ট্রাউজার আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮৯৩ কোটি ৮ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এ আমদানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ।

বাংলাদেশ থেকে পোশাকের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, ট্রাউজার আগে বড় পরিসরে উৎপাদন হতো মূলত চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায়। এসব দেশে পরিচালন ব্যয় (ওভারহেড কস্ট) বেড়ে গেছে  ফলে বৃহদায়তনের উৎপাদনগুলো সরে এসেছে বাংলাদেশে। আবার ট্রাউজার উৎপাদন কার্যক্রমের একটি জরুরি অনুষঙ্গ হলো ওয়াশিং। চীনে এখন পরিবেশসম্মতভাবে ওয়াশিং প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি। এ ইস্যুতে বন্ধ হয়ে গেছে দেশটির অনেক ওয়াশিং কারখানা। সে তুলনায় বাংলাদেশে ওয়াশিং কার্যক্রম চালানো বেশ সহজ। এখানে কারখানাগুলোকে পরিবেশসম্মততা নিয়ে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। এ বিষয়টিও বাংলাদেশে ট্রাউজারের উৎপাদন সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউরোপভিত্তিক বৃহৎ পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চীনে পরিবেশগত বিষয়গুলো মেনে চলা হচ্ছে। এছাড়া বাস্তবতা হলো মৌলিক পোশাকপণ্য সেলাই করে বেশি আয় করা কঠিন। ট্রাউজার উৎপাদনের প্রক্রিয়া তুলনামূলক দীর্ঘায়িত ও জটিল। প্রতিটি ধাপেই এতে মূল্যসংযোজনের সুযোগ থাকে  এতে সরবরাহকারীদের আয়ও বাড়ে। এক্ষেত্রে কাপড় ক্রয়, ওয়াশিং বা অ্যাকসেসরিজ পর্যন্ত সব পর্যায়েই মার্জিন যোগ করা যায়। সব মিলিয়ে একটি কারখানা মৌলিক পণ্য দিয়ে শুরু করে যখন পুরনো হয়, তখন উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে ট্রাউজারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।’

বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশই পোশাক খাতের পণ্য। গত চার দশকে শিল্পটি ধীরে ধীরে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। এ চালিকাশক্তির ভিত মূলত পাঁচ-ছয়টি পণ্য। ইপিবি ও পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে মূলত দুই ক্যাটাগরিতে পোশাক রফতানি হয়। একটি হলো নিট, অন্যটি ওভেন। এ দুই ক্যাটাগরিতে মূলত পাঁচ ধরনের পণ্য রফতানি করেন পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকরা। এগুলো হলো ট্রাউজার, টি-শার্ট, নিটেড শার্ট, সোয়েটার, শর্টস, ব্লাউজ ও আন্ডারওয়্যার। তৈরি পোশাক খাতে মোট রফতানির ৮২ শতাংশই দখল করে রেখেছে এ পাঁচ পণ্য।

বিশ্বে নারীর ব্যবহূত কটন নিটেড ট্রাউজার আমদানির অর্থমূল্য ২০২১ সালে ছিল ৯৩০ কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।পুরুষের ব্যবহূত কটন সিনথেটিক ট্রাউজার আমদানির অর্থমূল্য ২০২১ সালে ছিল ৮১১ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। একই বছর পুরুষের ব্যবহূত কটন নিটেড ট্রাউজার আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৫৯৪ কোটি ৫৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বিশ্বে নারীর ব্যবহার্য সিনথেটিক ওভেন ট্রাউজার ২০২১ সালে আমদানি হয় ৬২৮ কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। এতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। একই বছর নারীর নন কটন ওভেন ট্রাউজার আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৩৫৮ কোটি ২৬ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। নারীর সিনথেটিক নিটেড ট্রাউজার আমদানির অর্থমূল্য ২০২১ সালে ছিল ৯৩৪ কোটি ৩ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। এতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ২ দশমিক ২৪ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের রফতানি খাতে বহুমুখিতার ঘাটতি অনেক দিন ধরেই। এ পরিস্থিতি থেকে ধীরে হলেও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন রফতানিকারকরা। তবে পোশাকের বৈশ্বিক বাজার বিবেচনা করলে মৌলিক পণ্যের চাহিদা সবসময়ই আছে ও থাকবে। অর্থনৈতিক মন্দায়ও এ ধরনের পণ্যের চাহিদা কমে না। ফলে মৌলিক পণ্যের সক্ষমতা ধরে রেখেই উৎপাদন বৈচিত্র্য বাড়াচ্ছেন রফতানিকারকরা।

বাংলাদেশ এখন শুধু মৌলিক ট্রাউজার পণ্যে আটকে নেই বলে মনে করছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্যমতে, কারখানার মানোন্নয়নে এখন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে  এ বিনিয়োগ করতে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তাই উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরির মতো প্রযুক্তি স্থাপন করছেন। ট্রাউজারে আরো ভালো মূল্যসংযোজন কীভাবে করা যায়, সেদিকেও মনোযোগী হয়েছেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ট্রাউজার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একক পণ্য হিসেবে ট্রাউজার রফতানি বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এখন নিট পণ্যের আধিপত্য বেশি। ট্রাউজার রফতানি বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে জিন্স প্যান্ট রফতানির সামর্থ্য বাংলাদেশের অনেক বেড়েছে। ফলে পণ্যটির রফতানি প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো। আর আমার মনে হয়, এ প্রবৃদ্ধির একটা বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার। কভিডের প্রভাবে চীন ও ভিয়েতনামে অনেক দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। সে সুযোগে বাংলাদেশে অনেক ক্রয়াদেশ সরে এসেছে। ডেনিম কাপড়ের স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাবও ট্রাউজার রফতানিতে দেখা যাচ্ছে। আবার নন-ডেনিম কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতাও আগের চেয়ে ভালো বাংলাদেশের। সামগ্রিকভাবে কাপড় উৎপাদনে স্থানীয় সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার কারণেও ট্রাউজার রফতানিতে ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পণ্যের মানও আগের চেয়ে ভালো। নকশা ও মূল্যসংযোজন বিবেচনায় মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের পণ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশের কারখানাগুলো অনেক ভালো করছে। সব মিলিয়ে ট্রাউজারের অবস্থান অনেক ভালো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, উচ্চমূল্যের পণ্যের মান নিয়ে ক্রেতারা অনেক বেশি সচেতন, আবার একই সঙ্গে দাম নিয়েও কিছুটা নমনীয়  সাধারণ একটি পোশাকে পণ্যভেদে ৫-২৫ শতাংশ বেশি মূল্য পাওয়া যায়, কিন্তু ক্রেতারা সব ধরনের প্রস্তুতকারককে এ ধরনের পণ্য সরবরাহের রফতানি আদেশ দেন না। কারণ প্রস্তুতকারকরা বিভিন্ন সমস্যার কারণে এ ধরনের পণ্য তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

জানা যায়, একটি মূল্যসংযোজিত পোশাক তৈরিতে প্রক্রিয়া থাকে বেশি। এর বড় উদাহরণ হলো ডেনিম প্যান্ট  বেশি দামি একটি ডেনিম পণ্যের পিসপ্রতি ফ্রেইট অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য পাওয়া যায় ১৫-২০ ডলার। দাম বেশি বলেই এটি তৈরির প্রক্রিয়াও দীর্ঘ। যেমন—ওয়াশ, এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট, ডায়িং, স্পেশাল মেটাল বাটন সংযোজন। তৈরি পোশাকে দেশের বেশির ভাগ কারখানায় সব ধরনের সুবিধা একসঙ্গে পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে একটি কারখানায় কাটিং ও সুইং থাকে। এরপর ওয়াশ, এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট, ডায়িং, স্পেশাল মেটাল বাটন লাগানোর মতো প্রক্রিয়াগুলোর জন্য ভিন্ন কারখানায় যেতে হয়। ফলে বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ। ক্রেতার দেয়া বেশি এফওবির সুবিধা কাজে লাগাতে পারেন না প্রস্তুতকারকরা।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘বৈশ্বিকভাবে তুলাজাত বস্ত্র ও পোশাকের অংশ মাত্র ২৫ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকপণ্যের ৭৫ শতাংশই তুলাজাত। অর্থাৎ বিশাল সুযোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। খেলাধুলার পোশাক, অন্তর্বাস, আউটারওয়্যার ইত্যাদির মতো উচ্চমানের পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। যদিও এ পণ্যের বাজার অনেক বড়। বৈশ্বিক নন-কটন মার্কেটে অংশীদারত্ব বাড়ানোর জন্য আমাদের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বাড়াতে হবে। আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে আরো বিনিয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশগত দিকটাও মাথায় রাখতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
Theme Created By Limon Kabir