ভারতের বিরুদ্ধে জম্মু ও কাশ্মিরে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা।
পেহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের ব্যাপক অভিযান, নির্বিচার আটক, নির্যাতন, ভাঙচুর ও যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কড়া সমালোচনা করেছেন তারা।
চলতি বছরের এপ্রিলে পেহেলগাঁওয়ের পর্যটন এলাকায় হওয়া সেই হামলায় ২৬ জন নিহত হয়।
এদিকে ভারতকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলতে হবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘের ওই মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পেহেলগাঁও পর্যটন এলাকায় হামলার পর ভারত যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পুরো অঞ্চলে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার পরিসর ও কঠোরতায় তারা উদ্বিগ্ন। নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করলেও ভারতকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলতে হবে।
এক বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পর্যটন এলাকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাকে আমরা স্পষ্টভাবে নিন্দা জানাই এবং নিহতদের পরিবার ও ভারতের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। তবে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের সময়ও সব সরকারকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সম্মান করতে হবে।
হামলার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জম্মু ও কাশ্মিরজুড়ে ব্যাপক অভিযান চালায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময় প্রায় ২ হাজার ৮০০ জনকে আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীও ছিলেন।
এছাড়া কিছু ব্যক্তিকে পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট এবং আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট–এর আওতায় আটক রাখা হয়। এসব আইনের মাধ্যমে মূলত অভিযোগ না পেলেও দীর্ঘমেয়াদে আটক রাখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব আইনে ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দের সংজ্ঞা অস্পষ্ট ও অতিরিক্ত বিস্তৃত।
বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আটককৃত কিছু ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়েছে, গোপন স্থানে রাখা হয়েছে এবং আইনজীবী বা পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তারা বলেন, ‘ইচ্ছামতো গ্রেফতার–আটক, হেফাজতে সন্দেহজনক মৃত্যু, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ, গণপিটুনি এবং কাশ্মিরি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের এসব তথ্য খুবই উদ্বেগজনক।’
এছাড়া কাশ্মিরে শাস্তিমূলকভাবে ঘরবাড়ি ভাঙা, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং নির্বিচারে বাস্তুচ্যুত করার ঘটনাও তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আদালতের কোনও আদেশ বা আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই সন্ত্রাসীদের সমর্থক হিসেবে দেখা হয় এমন ব্যক্তিদের পরিবারের বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের ব্যবস্থা ‘সমষ্টিগত শাস্তির সমান’ এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ২০২৪ সালের রায়ের লঙ্ঘন। ওই রায়ে আদালত এই ধরনের ভাঙচুরকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছিল এবং জীবন ও মানবিক মর্যাদার অধিকার লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছিল।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা জানান, দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে ওই অঞ্চলে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রায় ৮ হাজার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়— যার মধ্যে সাংবাদিক ও স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টও ছিল। তাদের মতে, এটি মতপ্রকাশ, সংগঠিত হওয়া ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের লঙ্ঘন।
ভারতের এসব পদক্ষেপের প্রভাব কাশ্মিরের বাইরেও পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা কাশ্মিরি শিক্ষার্থীরা নজরদারি ও হয়রানির মুখে পড়েছেন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়ার পর।
তারা আরও বলেন, শাসক দলের রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা–উসকানি বেড়েছে। গুজরাট ও আসামেও ঘরবাড়ি ভাঙার ঘটনা সামনে এসেছে। সেখানে হাজার হাজার মুসলিমের বাড়ি, মসজিদ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রায় এক হাজার ৯০০ মুসলিম ও রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর এই কাজ করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের বিতাড়ন ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতির লঙ্ঘন। এই নীতির অধীনে মূলত কাউকে এমন দেশে পাঠানো যায় না, যেখানে তাদের নির্যাতন, হত্যার ঝুঁকি বা গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই অভিযোগগুলো জম্মু ও কাশ্মিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই ধারাবাহিকতা। ইরফান মেহরাজ ও খুররম পারভেজসহ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী বহু বছর ধরে নিরাপত্তা আইনে আটক রয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তারা।
তারা বলেন, যাদের ইচ্ছামতো আটক রাখা হয়েছে, তাদেরকে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মিরে ইচ্ছামতো আটক রাখা সব ব্যক্তিকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির আহ্বান জানাই।
ভারতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার আহ্বানও জানানো হয়। এছাড়া সকল অভিযোগের স্বাধীন তদন্ত ও প্রয়োজন হলে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জবাবদিহির দাবিও তোলেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা সতর্ক করে বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপের নামে বাড়াবাড়ি শুধু মানবিক মর্যাদা, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনকেই লঙ্ঘন করে না— বরং সামাজিক বিভাজন বাড়িয়ে ভবিষ্যতে আরও সহিংসতার ঝুঁকিও তৈরি করে।
এছাড়া কাশ্মির ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংলাপ শুরুর আহ্বানও জানান বিশেষজ্ঞরা। সূত্র: ইউএন, আনাদোলু এজেন্সি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড
প্রকাশক : সোহেল রানা সম্পাদক: আব্দুস সামাদ সায়েম
©২০১৫-২০২৫ সর্বস্ত্ব সংরক্ষিত । তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত (নিবন্ধন নং-২১০)