শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন

প্রাণহীন এফডিসিতে নায়ক-নায়িকা নেই, সিনেমার শুটিংও নেই

রিপোর্টারের নাম / ৩৫২ বার দেখা হয়েছে
আপডেট করা হয়েছে শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩, ২:৫৭ অপরাহ্ন

বিনোদন ডেস্ক:

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ, সম্পাদনা থেকে শুরু করে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে বরাবরই এফডিসি বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে গত এক দশক ধরেই ৬০ বছরের বেশি বয়সী এই প্রতিষ্ঠানের জৌলুশ কমতে শুরু করেছে।

এফডিসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৭ সালের এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্রের জন্য এই প্রতিষ্ঠান তৈরির বিল সংসদে প্রস্তাব করেছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।

সেই প্রস্তাবের আলোকে এফডিসি তৈরি হয়েছে বলে এই দিনটিকে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসাবে ২০১২ সাল থেকে পালন করছে সরকার।

কিন্তু যে এফডিসি একসময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রধান কেন্দ্র ছিল, অভিনয়-শুটিং, এডিটিং মিলে সরগরম পরিবেশ ছিল, এখন কেন সেটা অনেকটাই জৌলুসহীন, কর্মহীন পরিবেশে পরিণত হয়েছে? ডিজিটাল, ওভার দ্যা প্লাটফর্ম কনটেন্টের ভিড়ে উপযোগিতা কতটা ধরে রাখতে পারছে এফডিসি?

সরেজমিনে এফডিসি

সোমবার দুপুরে এফডিসিতে গিয়ে সংবাদদাতা দেখতে পান, একটি অংশে চলচ্চিত্র দিবসের অনুষ্ঠান চলছে, সংবাদকর্মী এবং কর্মকর্তাদের ভিড় রয়েছে, কিন্তু এফডিসির বাকি অংশ অনেকটাই নীরব।

কোথাও কোন শুটিং হচ্ছে না, ডাবিং বা এডিটিংয়ের তেমন কোন কাজ নেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোন ভিড় নেই।

সেখানকার একজন নিরাপত্তা কর্মী নুরুল হক জানালেন, আগে একসময় প্রতিদিন দুই তিনটি সিনেমার শুটিং হতো। কিন্তু এখন আর খুব একটা সিনেমার শুটিং এখানে হয় না। মাঝে মাঝে কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ হয় আর টেলিভিশনের কিছু প্রোগ্রাম হয়।

পুরো এলাকা জুড়ে একটি অলস পরিবেশ। কোথাও কোন কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ছে না। সড়ক, ভবন এমনকি রাস্তাঘাট জুড়ে অযত্নের ছাপ।

এফডিসির পুরো এলাকার অর্ধেকের বেশি অংশের ভবন ভেঙ্গে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এই ভবনে চলচ্চিত্র নির্মাণ, এডিটিং, স্টুডিও, প্রেক্ষাগৃহ থেকে শুরু করে সিনেমা সম্পর্কিত যাবতীয় সুযোগ সুবিধা থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ কাজ এফডিসিতে হতো। সেই সময় সপ্তাহে এখানে পাঁচ/ছয়টি চলচ্চিত্রের শুটিং হওয়ারও নজীর রয়েছে। কিন্তু এখন সেই চিত্র বদলে গেছে।

এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে এখন ডাবিং বা সাউন্ডের কিছু কাজ করা হলেও চলচ্চিত্রে শুটিং হয়না বহুদিন ধরে। বেশিরভাগ নির্মাতা ছবির কাজ করার জন্য ঢাকা ও আশেপাশের বিভিন্ন শুটিং স্পট বেছে নেন। অনেকে দেশের বাইরেও চলে যান।তবে সেন্সরে যাওয়ার আগে এফডিসির একটা ছাড়পত্র দরকার হয়।একজন কর্মকর্তা জানালেন, অনেক নির্মাতা এখন ওই ছাড়পত্র ছাড়া আর কোন কাজের জন্যই এফডিসিতে আসেন না।

কেন এফডিসিতে আসছেন না নির্মাতারা

এই স্থানে বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক নাচ-গানের দৃশ্যায়ন হলেও এখন নীরব হয়ে পড়েছে
এই স্থানে বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক নাচ-গানের দৃশ্যায়ন হলেও এখন নীরব হয়ে পড়েছে

এফডিসির কর্মকর্তা, চিত্র পরিচালক, শিল্পী এবং কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে এখানে আধুনিক প্রযুক্তির ক্যামেরা, এডিটিং প্যানেল ও ডাবিং প্যানেল রয়েছে।

তারপরেও নির্মাতা ও প্রযোজকরা এফডিসির বদলে বাইরের বেসরকারি স্টুডিও বা শুটিং হাউজগুলোকে তাদের কাজের জন্য বেছে নিচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা  বলেছেন, ‘’আমাদের এখানে কাজ করতে যে টাকা খরচ করতে হয়, বাইরের শুটিং হাউজগুলোয় এর চেয়ে কমে তারা করতে পারে। এখানে যেমন শিফট হিসাবে পেমেন্ট করতে হয়, দুই শিফট কাজ হলে দুই শিফটের টাকা দিতে হয়. কিন্তু ওসব জায়গায় তারা প্যাকেজ আকারে সুবিধা পান। আবার ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি মিলিয়ে এখানে তাদের যে খরচ পড়ে, বাইরে কাজ করলে এর চেয়ে কমে করতে পারেন। তাহলে তারা কেন এফডিসিতে আসবেন?’’

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র ও নাটক ঘিরে অসংখ্য বেসরকারি শুটিং স্পট গড়ে উঠেছে। সেসব স্থানে শুটিংয়ের সুবিধা, ক্যামেরা, এডিটিংসহ এমনকি থাকার সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। ফলে পরিচালক, প্রযোজক এবং নির্মাতারা সেসব স্থানে শুটিং করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

এফডিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে কাজ করতে হলে আগে থেকে প্রযোজক সমিতির সদস্য, পরিচালক সমিতির সদস্য হতে হয়। শিল্পী সমিতির সদস্যদের নেয়ার জন্যও চাপ থাকে। ফলে অনেক পরিচালক আর এখানে শুটিং করতে চান না।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিহাব সুমন  বলছেন, ‘’এফডিসির সেই রমরমা অবস্থা এখন নেই। এফডিসিতে যেসব ইকুইপমেন্ট আছে, সেগুলোর ভাড়া একটু বেশি। এটা নিয়ে আমরা অনেকদিন বলেছি, কিন্তু কিছু হয়নি। বাইরে অনেক হাউজ তৈরি হয়েছে, সেখানে সবাই চলে যাচ্ছে। কারও বাজেট ভালো হলে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।‘’

‘’অতীতে এফডিসির যে গৌরবোজ্জ্বল দিন ছিল, আমাদের যে সোনালী অতীত ছিল তা পুনরুদ্ধার করা অনেক কঠিন। কারণ শিল্প যদি ঘুরে না দাঁড়ায়, তাহলে চলচ্চিত্রের, এফডিসির যে অবস্থান বা মূল্যায়ন, সেটা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম,’’ তিনি বলছেন।

পুরো এফডিসি জুড়ে একপ্রকার অলস আর নীরব পরিবেশ রয়েছে। কারণ এখানে এখন পরিচালক বা শিল্পীদের খুব একটা আনাগোনা হয় না।
এফডিসিতে এখন পরিচালক, কুশলী, শিল্পীদের খুব একটা আনাগোনা নেইা।

পরিচালকরা বলছেন, এফডিসিতে অনেক নতুন আধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম এসেছে, কিন্তু সেগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মী নেই। ফলে এসব দামী দামী সরঞ্জামের ঠিকমতো ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

‘’এফডিসিতে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিল। কিন্তু যন্ত্রপাতি আনলেই তো হবে না, সেগুলো চালানোর মতো দক্ষ লোক তো লাগবে। এসব প্যানেল কোন কাজেই আসেনি, কারণ দক্ষ লোক ছিল না। যেসব দামী ক্যামেরা আছে, সেগুলোও পড়ে থাকে। বাইরের হাউজগুলোয় যে কাজ ১০ টাকায় পাওয়া যায়, এখানে করতে গেলে সেটা পড়ে ১৬ টাকা। তাই এখানে বেশিরভাগ পরিচালক কাজ করতে চায় না,’’ বলছেন পরিচালক শিহাব সুমন।

ফলে একসময় চলচ্চিত্রের যেসব কর্মকাণ্ড ঢাকার কারওয়ান বাজার সংলগ্ন এফডিসি ঘিরে ছিল, এখন সেটা ছড়িয়ে পড়েছ বিভিন্ন শুটিং হাউজগুলোয়। ফলে গুরুত্ব হারিয়েছে এফডিসি।

এতদিন ধরে আয় তেমন না থাকলেও সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়ে আসলেও চারমাস আগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে এফডিসি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়, এখন থেকে তাদের নিজেদের আয়েই নিজেদের চলতে হবে। কিন্তু কাজ সংকটে এফডিসির আয় কমে যাওয়ায় সেখানকার দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাকি পড়ে রয়েছে।

এফডিসির বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন কলা-কুশলী কর্মচারী শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব বলছেন, ‘’আমাদের মেশিন আছে, আমাদের টেকনিশিয়ান নাই। আমাদের ভালো জিনিস আছে, কিন্তু সেটা চালানোর মতো লোক নেই। ফলে আমরা সেটা ব্যবহার করতে পারছি না। তাই বাইরের পার্টিকে আমরা টানতে পারছি না, তারা এখানে আসছে না।‘’

তাদের দাবি, ডিজিটাল কনটেন্টের ওপর দর্শকরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় প্রচলিত সিনেমার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে এসেছে। আবার এখন টেলিভিশন বা ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য যেসব অনুষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে, তারা যতটা সম্ভব খরচ কমানোর চেষ্টা করেন। এফডিসির সহায়তা না নিয়েও তারা কম খরচে এসব করতে পারছেন।

নতুন ভবনে আশাবাদ কর্তৃপক্ষের

এফডিসির বড় একটি অংশ ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে, যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণে সব ব্যবস্থা থাকবে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে।
এফডিসির বড় একটি অংশ ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে, যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণে সব ব্যবস্থা থাকবে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে।

এফডিসি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকদের আগ্রহ কমে গেছে, সেটা উপলব্ধি করতে পারছে এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও।

এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন বলছেন, ‘’হয়তো পুরনো আদলে হবে না, কোন জিনিসই তো সবসময় টিকে থাকে না, ওটার প্যাটার্নটা চেঞ্জ হয়। আপনি জানেন, আমাদের এখানে একটা কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। সেখানে কোন একজন নির্মাতা যখন ঢুকবেন, সব কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাবেন। সবটা এক জায়গায় করা যাবে। গাজীপুরের কবিরপুরে আমাদের একটা শুটিং স্পট আছে, সেখানেও একজন নির্মাতা গেলে সিনেমার সব কাজ করে বেরিয়ে যেতে পারবেন। সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ওখানে রাখা হয়েছে।

এফডিসিতে কাজ করতে খরচ বেশি হয়, নির্মাতাদের এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘’তারা এটা বলেন, কিন্তু আমরা তো দেখি আমাদের যন্ত্রপাতির মানের তুলনায় খরচ আসলে কম। আমরা তাদের বহুবার বলেছি, আপনারা বাইরে থেকে হিসাবটা এনে দেখান, সেটা ওনারা দেখাননি।‘’

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে এফডিসি এখনো কতটা গুরুত্বপূর্ণ – এই প্রশ্নে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম  বলেন, ‘’এফডিসি আসলে এখন কোনও সার্ভিস ঠিকমতো দিতে পারে না, এটা আসলে এখন বার্ডেন হয়ে গেছে। তারা পরিচালক-প্রযোজকের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে পারছে না, সেই ইচ্ছাও তাদের দেখা যায় না। ফলে বেশিরভাগ পরিচালক-প্রযোজক সেখানে এখন যান না।‘’

তিনি মনে করেন, ‘’এটার পরিবর্তন করতে হলে এফডিসির টপ-টু-বটম সবার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বেসরকারি খাত যেভাবে সেবা দিচ্ছে, সেইভাবে তাদের সেবার মান বাড়াতে হবে। শুধু ঘড়ি ধরে কাজ করে তো আর চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায় না।‘’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
Theme Created By Limon Kabir