
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে কোটি টাকা ব্যয়ে ইউনিব্লক দিয়ে সড়ক নির্মাণকাজে শুরু থেকেই চলছে ব্যাপক অনিয়ম। অত্যন্ত নিম্নমানের খোয়া, মাটি ও প্যালাসাইটিং সামগ্রী ব্যবহার, তদারকির ঘাটতি এবং ঠিকাদারের অবহেলায় কাজ শুরুর পরই উন্মোচিত হয়েছে দুর্নীতির বহর। ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয়রা শেষ পর্যন্ত কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের সার্ভেয়ারও।
উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায় বারগাঁও ইউনিয়নের মিয়াপুর থেকে বগাদিয়া হয়ে অম্বরনগর সড়কটির সংস্কার ও নতুন ইউনিব্লক নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর আওতায় ৬৮৩ মিটার ইউনিব্লক রাস্তা এবং ৯৭ মিটার প্যালাসাইটিং (গাইড ওয়াল) নির্মাণের কথা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জিওবি মেইনটেনেন্স প্রকল্পে ‘মেসার্স কাজী ট্রেডার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স’ নামের প্রতিষ্ঠানটি কাজ পায়।
কিন্তু কাজ শুরুর পর থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ওঠতে থাকে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, নিয়মানুগ কাঠামো না মানা এবং স্থানীয়দের অভিযোগকে উপেক্ষা করার মতো একাধিক অভিযোগ।
গত রবিবার (২৩ নভেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সাব-বেস নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে অতি নিম্নমানের খোয়া ও মাটি। খোয়া হাতে নিলেই গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশ থেকে কাটানো মাটি দিয়ে বেস তৈরির চেষ্টা চলছে, যা নিয়মবহির্ভূত। কোথাও কোথাও সাব-বেসে এক ইঞ্চি চাপ দিলেই দেবে যাচ্ছে পুরো অংশ।
আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা যায় প্যালাসাইটিং বা গাইড ওয়ালে। নির্মাণের কয়েকদিনের মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে লম্বা ফাটল দেখা দিয়েছে। কোথাও পুরো গাইড ওয়াল একপাশে হেলে পড়েছে। ইটের গাঁথুনি আলগা, সিমেন্ট বালুর মিশ্রণের অনুপাতও মানসম্মত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন কাঠামো বর্ষায় পানি চাপ সহ্য করার আগেই ভেঙে পড়তে পারে।
দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল সড়কটি। গত বছরের ভয়ারাস্তা পুরোপুরি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। রশিদপুর, লতিফপুর, রাজিপুর, কৃষ্ণপুর, ঘোষকামতা এই পাঁচ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পথ ছিল এটি। তাই মানুষ অপেক্ষায় ছিল মানসম্মত সড়কের জন্য।
কিন্তু স্থানীয়দের দাবি ঠিকাদার ওয়াসিম মেম্বার কাজ শুরুর পর থেকেই নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজের মতো করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তা উঁচু করতে পাশের জমি থেকেই মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। সাব-বেস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ভাঙাচোরা পুরাতন ইটের খোয়া ও মাটি। গাইড ওয়ালেও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে।পুরাতন ইট আর মাটি মিশিয়ে রাস্তা বানানো হচ্ছে। রোলার চালালেই ধুলো উড়ে যায়। কোটি টাকা খরচ করে এমন রাস্তা বানালে দুই বছরও টিকবে না।
স্থানীয় যুবক রানা, সাজিদ, মোহনসহ আরও অনেকে বলেন কাজের প্রতিটি ধাপে অনিয়ম হচ্ছে। গাইড ওয়ালে ফাটল ধরেছে। কয়েক জায়গায় রাস্তা এখনই গর্ত হয়ে গেছে। গাছের শেকড় না সরিয়েই খোয়া ফেলা হচ্ছে। এসব দেখে আমরা বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।
গ্রামবাসী কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পর সোমবার সোনাইমুড়ী উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের সার্ভেয়ার আব্দুল আলিম। তিনি খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেন নিম্নমানের খোয়া, সঠিকভাবে বেস প্রস্তুত না করা এবং গাইড ওয়ালে ফাটল এসব অভিযোগের সত্যতা রয়েছে। তিনি পুরো বিষয়টি লিখিতভাবে উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে রিপোর্ট করবেন বলে জানান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদার ওয়াসিম মেম্বার দাবি করেন কাজ এখনো শেষ হয়নি। কাজ শেষ করার আগে সব ঠিক করে দেওয়া হবে।কিন্তু সাব-বেসের ৫০ শতাংশ নিম্নমানের খোয়া দিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সেটি কিভাবে ঠিক করা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি তিনি। ফলে তার বক্তব্য স্থানীয়দের সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে।
সোনাইমুড়ীর এই সড়কটি শুধু পাঁচ গ্রামের মানুষের যোগাযোগের প্রাণশক্তি নয়; বরং স্থানীয় বাজার, স্কুল কলেজ, কৃষিপণ্যের পরিবহনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই সড়কটি দীর্ঘস্থায়ী ও মানসম্মত করার দাবি বহুদিনের।
কিন্তু কোটি টাকা বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, প্রকৌশলীদের তদারকির ঘাটতি, ঠিকাদারের অবহেলা সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন সরকারি প্রকল্প কি শুধু কাগজে-কলমেই মানসম্মত? মাঠে কেন বারবার এমন অনিয়ম ধরা পড়ে?
স্থানীয়দের অভিযোগ ঠিকাদারের ‘চুরি’ রোধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। নইলে বরাদ্দের টাকা যাবে ঠিকাদারের পকেটে, আর রাস্তা ভাঙবে বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতেই।
গ্রামবাসীর একটাই দাবি অনিয়ম বন্ধ হোক, নিম্নমানের সামগ্রী বাতিল করে নতুনভাবে কাজ শুরু করা হোক। প্রকৌশল অধিদপ্তর যেন নিয়ম মানতে ঠিকাদারকে বাধ্য করে। আর দুর্নীতির সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে উদাহরণযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হোক।কারণ মানুষের মতে এই সড়কটি ৫ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত। এটি কেবল ইট-খোয়ার রাস্তা নয়, আমাদের ভবিষ্যতের পথ।
সোনাইমুড়ী উপজেলা প্রকৌশলী মো. এমদাদুল হক বলেন অভিযোগ পাওয়ার পরই আমি সার্ভেয়ারকে পাঠিয়েছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর আমি নিজে গিয়ে সবকিছু যাচাই করব। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে ঠিকাদারের বিরুদ্ধের এত অভিযোগের পরও এখন পর্যন্ত কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধের ঘোষণা বা সামগ্রী পরিবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এতে প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এলাকাবাসী।
প্রকাশক : সোহেল রানা সম্পাদক: আব্দুস সামাদ সায়েম
©২০১৫-২০২৫ সর্বস্ত্ব সংরক্ষিত । তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত (নিবন্ধন নং-২১০)