লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) ব্যবহার যেমন দ্রুত বাড়বে, তেমনি বাড়বে এনার্জি সংরক্ষণের সক্ষমতাও। ফলে দেশের জ্বালানি খাতের দৃশ্যপটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেবে এ উদ্যোগ। বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে একটি অত্যাধুনিক উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
উচ্চাভিলাষী এ প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের নেতৃত্বে ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম ৩৩২.৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে।
এই অত্যাধুনিক উৎপাদন কেন্দ্রটির বার্ষিক সক্ষমতা হবে ১ গিগাওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ এ উৎপাদন কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং আইপিএস ও ইউপিএস সিস্টেমের মতো শক্তি সঞ্চয়ী ব্যবস্থাগুলোর (এনার্জি স্টোরেজ অ্যাপ্লিকেশন) জন্য উচ্চমানের ব্যাটারি তৈরি করা যাবে।
বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবির সোমবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘ইতিমধ্যেই কারখানার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে, তাই আমরা ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা করছি।’
কবির বলেন, তাদের কোম্পানি বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের প্রকল্পও নিয়েছে। লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন কেন্দ্রট সেই ইভি উৎপাদন প্রকল্পে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ তৈরি করবে। পাশাপাশি শক্তি সঞ্চয়ী ব্যবস্থাগুলোর জন্য বাজারে বর্তমানে যে পরিমাণ লিথিয়াম ব্যাটারির চাহিদা আছে, কার্যকরভাবে তার সমাধানও করবে।
লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির জায়গা নেবে লিথিয়াম। বাংলাদেশে আইপিএস ও ইউপিএসে সাধারণত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। কবির বলেন, ‘লিথিয়াম ব্যাটারি তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব এবং লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির এক বছরের বিপরীতে এর আয়ুষ্কাল ১৫ বছর।’
তিনি জানান, এ উৎপাদন কেন্দ্রে কোরিয়ান, জাপানি ও চীনার প্রযুক্তির মিশ্রণে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
রোববার ঋণদাতা ও লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাউসার আমীর আলী। তিনি এই পদক্ষেপটিকে একটি মাইলফলক বলে অভিহিত করেন।
আমীর আলী টিবিএসকে বলেন, ‘দেশে ৩০-৪০ লাখ থ্রি-হুইলার রয়েছে যেগুলো লেড-অ্যাসিড ব্যাটারিতে চলে। এসব ব্যাটারি বদলে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে। আমরা সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে চার্জিং পয়েন্ট স্থাপন করতে চাই।’
তিনি বলেন, এই ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন কারখানাও স্থাপন করেছে। এর ফলে বাংলাদেশে ইভির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
ঋণের অন্যতম জোগানদাতা ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী রেজা ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশের প্রথম লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন দেশের শিল্প খাতকে শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে পরিচ্ছন্ন ও টেকসই জ্বালানি ব্যবহারের যে ধারা শুরু হয়েছে, এ উদ্যোগ তার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ এ প্রকল্পের কার্যকারিতা ও সম্ভাবনার প্রতি তাদের আস্থাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবিরের তথ্যমতে, একটি ১ গিগাওয়াট-ঘণ্টা লিথিয়াম ব্যাটারি দিয়ে কতগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ি চালানো যাবে, তা নির্ভর করবে একটি ইভির গড় ব্যাটারি-সক্ষমতা এবং চার্জিং ও ডিসচার্জিং প্রক্রিয়ার দক্ষতার মতো বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর।
একটি গড় ইভি ব্যাটারির ক্ষমতা যদি ৫০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা হয়—যা মাঝারি রেঞ্জের বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য সাধারণ রেঞ্জের—তাহলে ১ গিগাওয়াট ঘণ্টার লিথিয়াম ব্যাটারি দিয়ে ২০ হাজার ইভি চলবে।
লিথিয়াম ব্যাটারির প্রধান কিছু ব্যবহার
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি বৈদ্যুতিক গাড়ি, বাইক, স্কুটার ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রাথমিক শক্তির উৎস। এদের শক্তি ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি। এর ফলে অন্যান্য ব্যাটারি প্রযুক্তির তুলনায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে চালিত যানবাহন অনেকক্ষণ চালানো যায় এবং চার্জও করা তুলনামূলক অনেক দ্রুত।
অজস্র বহনযোগ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস—যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, ডিজিটাল ক্যামেরা, স্মার্টওয়াচ ও পোর্টেবল গেমিং কনসোল এই ব্যাটারিতে চলে।
সৌর ও বায়ুর মতো উৎসগুলো থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি সঞ্চয় করার জন্য গ্রিড এনার্জি স্টোরেজের মতো বড় আকারের এনার্জি মজুত ব্যবস্থায় লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। এই সিস্টেমগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখতে, বৈদ্যুতিক গ্রিডগুলোকে স্থিতিশীল করতে এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় ব্যাকআপ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সহায়তা করে।
এ ব্যাটারি সাধারণত পেসমেকার, ডিফিব্রিলেটর, ইনসুলিন পাম্প ও বহনযোগ্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদির মতো মেডিকেল ডিভাইসগুলোতে ব্যবহৃত হয়।
ওজনে হালকা হওয়ায় এবং শক্তি ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে মহাকাশযান, স্যাটেলাইট ও বিমানে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। যোগাযোগ, নেভিগেশন ও জরুরি সরঞ্জামসহ গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমগুলোকে শক্তি জোগায় এ ব্যাটারি।
বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনকারী
শক্তিশালী উৎপাদন অবকাঠামো থাকার সুবাদে বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনকারী হলো চীন। অনেকগুলো বড় বড় ব্যাটারি উৎপাদনকারী কোম্পানি এদেশে অবস্থিত। এই কোম্পানিগুলো দেশ ও দেশের বাইরে লিথিয়াম ব্যাটারি সরবরাহ করে।
লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনে আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো দক্ষিণ কোরিয়া। এলজি, স্যামসাং ও এসকে ইনোভেশনের মতো কোম্পানিগুলো স্বনামধন্য ব্যাটারি প্রস্তুতকারক। এরপরেই আসে জাপানী নাম। দেশটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাটারি শিল্প রয়েছে। প্যানাসনিক, সনি ও তোশিবার মতো কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন করে।