সেন্টমার্টিন দ্বীপ কাউকে লিজ দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে চায় না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, এ দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না।’ তিনি বলেন, দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কাউকে খেলতে দেওয়া হবে না। দেশের মাটি ব্যবহার করে কাউকে হামলা চালাতে দেওয়া হবে না।
সুইজারল্যান্ড ও কাতার সফর নিয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় সংসদের উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল, কীভাবে? তখন তো গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। তা হলে এখন তারা দেশ বিক্রি করবে, নাকি সেন্টমার্টিন বিক্রির মুচলেকা দিয়ে আসতে চায়? তিনি বলেন, ‘আমি এতটুকু বলতে পারি, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, এ দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে
চাই না। ওই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে (ওই সময়) আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। আর এখনো যদি আমি বলি, ওই সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তা হলে আমাদের ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটি হবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আমি কাউকে খেলতে দেব না। দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই। আমার দেশের মাটি ব্যবহার করে কেউ কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাবে, কাউকে অ্যাটাক করবে বা এই ধরনের কাজ আমরা হতে দেব না। আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি, শান্তিপূর্ণ সহযোগিতায় বিশ্বাস করি।’
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু এ দেশ ‘ওয়েস্টমিনস্টার টাইপ অব ডেমোক্রেসি’, ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় যে রকম নির্বাচন হয়; ঠিক সেইভাবে এখানে নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, বিরোধী দলের নানা প্রস্তাব, এখন তারা আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে খালেদা জিয়ার (বিএনপি চেয়ারপারসন) উক্তি ছিল, ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নাই।’ একবার যেটা তারাই বাদ দিয়েছে এবং এই পদ্ধতি তারাই নষ্ট করেছে। তারাই রাখেনি, সেটাকে আবার তারা ফেরত চাইছে। অথচ উচ্চ আদালতের রায় আছে এবং সেই মোতাবেক সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে যে একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধান আরেকজন নির্বাচিত সরকারপ্রধান দ্বারাই প্রতিস্থাপিত হবেন। এর বাইরে অনির্বাচিত কেউ আসতে পারবে না। এটা উচ্চ আদালতের রায়ে আছে, সংবিধানেও আছে।
এটা জানার পরও সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি কেন করা হচ্ছে?- এই প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মানে এই যে গণতান্ত্রিক ধারাটাকে নষ্ট করা, এই যে দীর্ঘ সাড়ে ১৪ বছর বাংলাদেশ সুষ্ঠুভাবে চলছে, আর্থসামাজিক উন্নতি করছে; সেটিকে নষ্ট করা। দেশবাসী এটিকে কীভাবে নেবেন, সেটাই প্রশ্ন। তারা কি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা চান, অর্থনৈতিক উন্নতি চান, দেশের মানুষের কল্যাণ হোক সেটা চান; নাকি আবার সেই ২০০৭ সালের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার সেই জরুরি অবস্থা, ধরপাকড় সেগুলো চায় সেটা দেশের মানুষকেই বিবেচনা করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, নির্বাচন বানচাল করার জন্য বিএনপি-জামায়াত যেভাবে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে, ৩ হাজার ৮০০ গাড়ি পুড়িয়েছে, তিন হাজারের ওপরে মানুষকে পুড়িয়েছে। কত মানুষ পঙ্গু হয়ে আছে, কত পরিবার ধ্বংস হয়ে আছে। জ্বালাও-পোড়াও করে মানুষের ক্ষতিগুলো করে দিয়েছিল তারা, সেটা মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে?
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এককভাবে কারও ওপর যেন নির্ভরশীল থাকতে না হয়, সেজন্যই ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সুইজারল্যান্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠকে কথা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। রামাফোসা জানিয়েছেন আগস্টে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে জোটের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সময়ে ব্রিকসে যোগ দিলে কোনো সুবিধা বাংলাদেশের হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রিকসে আমরা যোগ দেব এই কারণে, ব্রিকস যখন প্রথম এটার (প্রতিষ্ঠার) প্রস্তুতি নেয়, তখন থেকেই আমরা এর সঙ্গে ছিলাম এবং আছি। কিন্তু আমরা ফাউন্ডার মেম্বার হতে পারিনি। এখন আমরা চেয়েছি সেটার মেম্বার হতে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো একটার ওপর যেন নির্ভরশীলতা না হয়। কাজেই অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যেন আমাদের অর্থ বিনিময়ের সুযোগটা থাকে। আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যেন আমরা সহজে ক্রয় করতে পারি, আমার দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারি। সেই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করেই কিন্তু আমরা ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রার্থী বাছাইয়ে পরিচ্ছন্ন প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দিন। যে ফুলটি সবচেয়ে সুন্দর সেটি আমি বেছে নেব।’
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা আছে। এ কারণেই দেশটার উন্নতি হয়েছে। মানুষের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস ফিরে এসেছে, দারিদ্র্য দূর হয়েছে।’ তিনি বলেন, কাকে প্রার্থী করা হবে, কাকে হবে না এ ব্যাপারে আমাদের দলেরও একটা লক্ষ্য থাকে। একটা অবাধ নিরপেক্ষ স্বচ্ছ নির্বাচন হবে, এটা আমাদেরও দাবি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই দেশের ক্ষমতায় এসেছি চার চারবার এবং দেশের উন্নতিও করেছি। এমন না যে ক্ষমতায় এসে শুধু ক্ষমতাকে ভোগ করেছি।’
সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী যখন নির্বাচন হওয়ার কথা, ঠিক সেই সময়ই নির্বাচন হবে, এটাই হলো বাস্তবতা। তিনি বলেন, কোভিড ১৯-এর কারণে অর্থনীতির ওপর একটা চাপ পড়েছে। তখন তো সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে। এ ছাড়া ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বিদ্যুৎ সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, একটু বিদ্যুতের সমস্যা ছিল। সেটাও আস্তে আস্তে কেটে যাবে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ ?উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বন্যা, কালকে ঝড় হতে পারে। সেই সময় যেন আমাদের বাইরের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়। আমাদের খাবারদাবার যেন আমরা সংরক্ষণ করতে পারি এবং আপৎকালীন মানুষকে দিতে পারি সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় তিনি দেশে উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।