ঈদুল আজহার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। তবে এরই মধ্যে গৃহস্থ ও খামারি পর্যায়ে কোরবানির পশু বেচাকেনা জমে উঠেছে। এতে হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। পশু পরিবহণসহ আনুষঙ্গিক খাতেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতবদল হচ্ছে। এছাড়া বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান কিংবা নিজ নামে গরু-ছাগল কোরবানিসহ ঈদের আনুষঙ্গিক খরচের জন্য প্রবাসীরা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠেছে।
কোরবানির পশুর সিংহভাগই গ্রামের হওয়ায় সেখানে টাকার প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাড়ির গোয়াল কিংবা খামারে লালন-পালন করা গরু-ছাগল বিক্রির টাকা গ্রামীণ জনপদের মানুষের হাতে আসায় তাদের মধ্যে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাকাটার হিড়িক পড়েছে। অনেকে এ টাকা থেকে বিভিন্ন সময় দোকানিদের কাছ থেকে বাকিতে নেওয়া গোখাদ্য ও ওষুধপত্রের দাম পরিশোধ করছেন। ফলে সেখানকার হাটবাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নগদ অর্থের লেনদেন হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোরবানির আগে ও পরে মিলিয়ে সপ্তাহ দেড়েক সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে। যদিও সঠিক পরিকল্পনা ও হিসাব না রাখার কারণে এই লেনদেন থেকে সরকার কতটা রাজস্ব আদায় করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদুল আজহাকে ঘিরে শুধু কোরবানির পশু বেচাকেনাই নয়, এর সঙ্গে চামড়ার বাণিজ্যের দাদন লেনদেন, গরু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি-বঁটি-দা’র ব্যবসা রয়েছে। গরুকে খাওয়ানোর খড়, ভুষির দেদার বেচাকেনা হচ্ছে। জমে উঠেছে মসলা ও রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ব্যবসাও। সব মিলিয়ে প্রতিদিন একটি বিরাট অঙ্কের টাকা দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে মুদ্রা সরবরাহ, লেনদেন ও আর্থিক কর্মকান্ডের যে প্রসার ঘটে সাধারণত তা-ই আয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশের বিভিন্ন হাটে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি কোরবানির পশু বিক্রি হয়। জবাই হওয়া পশুর প্রায় অর্ধেকের মতো গরু ও মহিষ, বাকিটা ছাগল, ভেড়া এবং অন্যান্য পশু। এ বছরও এর কাছাকাছি সংখ্যক কোরবানির পশু বিক্রি হবে। আর বিক্রীত গরু-ছাগলের ৭৫ শতাংশই কেনা হচ্ছে গরিবের কাছ থেকে, যারা কোরবানি উপলক্ষে এই পশুগুলো লালন-পালন করেছেন। এতে গরিবের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়ে উঠেছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকারি নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি গরু-মহিষ, দুম্বা-ছাগল কেনার সময় ক্রেতাকে হাট ইজারাদারদের হাসিল দিতে হয়। যা থেকে সরকার প্রায় একশ’ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। তাছাড়াও কোরবানির পশু পরিবহণের সময় বিভিন্ন সেতুতে বিশাল অঙ্কের টোল আদায় হয়।
এদিকে কোরবানি হওয়া ৬০ লাখ গরুর প্রত্যেকটি চামড়ার মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলেও এর মূল্য হয় ৬০০ কোটি টাকা। আবার ৪০ লাখ ছাগলের প্রত্যেকটি চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৪০ কোটি টাকা। গরু এবং ছাগলের চামড়া মিলিয়ে এই পুরো টাকা চলে যাচ্ছে সরাসরি গরিবদের হাতে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে রপ্তানি খাতে চামড়ার অবস্থান তৃতীয়। কোরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতটি। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। মোট চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংগৃহীত হয় কোরবানির ঈদে। এ বাবদ ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন পর্যায়ের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকা দাদন দিয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। কোরবানি উপলক্ষে লবণের ব্যবসাও চাঙা হয়ে উঠেছে।
প্রতি বছর দেশে ২২ লাখ টন পেঁয়াজ, ৫ লাখ টন রসুন আর ৩ লাখ টন আদার চাহিদা থাকে। এর উলেস্নখযোগ্য অংশই ব্যবহার হয় কোরবানিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে কোরবানির বাজারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় এসব পণ্যের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩২ হাজার ৪৫৩টি পরিবারে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৯৩ জন সদস্যের জীবিকা নির্বাহ হয় কামার পেশার মাধ্যমে। এ পেশার মানুষ অপেক্ষায় থাকেন ঈদুল আজহার। রাজধানীর কামারশালাগুলোতে এ সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকার মতো বিক্রি আদেশ আসে।
এদিকে কোরবানির মাংস সংরক্ষণে বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় ফ্রিজ বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। ফ্রিজ ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে বছরে ১৫ লাখ ফ্রিজের চাহিদা আছে। বছরের ৩০ ভাগ ফ্রিজই বিক্রি হয় কোরবানির ঈদে। একইভাবে কোরবানির পশু কেনার পর যে ২/৩ দিন কোরবানি দাতা নিজের কাছে রাখেন এ সময় তাকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহারের জন্য বস্তার চট কেনা হয়, খাওয়ানোর জন্য কেনা হয় খড়, ভুষি ইত্যাদি। এসব কেনার ক্ষেত্রের কয়েক কোটি টাকা হাতবদল হয় কোরবানির বাজারে- যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
এদিকে কোরবানি ঘিরে রেমিট্যান্সের পালে উত্তাল হাওয়া লেগেছে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৬ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১১২ কোটি ৫৯ লাখ মার্কিন ডলার। এতে দৈনিক গড়ে দেশে আসে ৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। ১৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি মাসের ১৬ দিনে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ২০ কোটি ৭২ লাখ ১০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ কোটি ৯২ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৮৫ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৩২ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার।
ব্যাংক সূত্র জানায়, রেমিট্যান্সের এই ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রেমিট্যান্স বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিলেও এর একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসছে।
অর্থনীতিবিদ ডক্টর এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, এলোমেলোভাবে কোরবানির সময় বিশাল পরিমাণের টাকা দেশের বাজারে মুভমেন্ট করে। এর সঠিক হিসাব রাখা খুবই কঠিন, তবে এই বিপুল পরিমাণের অর্থ পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা গেলে তা জিডিপিকে সমৃদ্ধ করবে। একই সঙ্গে এর ফলে সরকারের রাজস্ব ভান্ডারও সমৃদ্ধ হবে।
তবে এর নেতিবাচক দিকও আছে। কারণ বাজারে বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। আর অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক দিক হলো বণ্টন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন হয়। এতে অধিকাংশ মানুষের কাছেই টাকা পৌঁছে যায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঈদকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটে। শহর ও গ্রামে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঈদের অর্থনীতির আকার যা-ই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন কতটুকু সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক পণ্যই এ উপলক্ষে আমদানি হয়ে আসে।