দেশে জ্বালানি সংকটে যখন ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, তখনই সুখবর দিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। গত শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের একটি পরিত্যক্ত কূপ থেকে নতুন করে গ্যাস সরবরাহ শুরু করে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি।
এ কূপ থেকে দৈনিক আট মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার কথা জানায় বাপেক্স। শুধু এই কূপটিই নয়, দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে আরও অন্তত ২৯টি পরিত্যক্ত কূপে নতুন করে ওয়ার্কওভারের (সংস্কার) কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বাপেক্স।
এর বাইরেও ২০২২-২৫ সময়কালের মধ্যে পেট্রোবাংলার ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনায়ও এনেছে পরিবর্তন। ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ নাম দিয়ে এসব কূপে অনুসন্ধান, ওয়ার্কওভার, খনন ও উন্নয়ন কাজ শেষ করা হবে ২০২৪ সালের মধ্যেই। যদি এই প্রোগ্রাম সফলভাবে শেষ করা যায় তাহলে দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভরতা অনেকটাই কমবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
বাপেক্স সূত্রে জানা যায়, গত ৯ জুন বেলা ১১টার পর তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের ২৪ নম্বর কূপ থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। পরিত্যক্ত হওয়ার পর কূপটির সংস্কার করে বাপেক্স। ৪৫ দিনে সংস্কার কাজ শেষ হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কূপটি খনন করেছিল চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাক। এরই ধারাবাহিকতায় আরও ২৯টি পরিত্যক্ত কূপ খনন, অনুসন্ধান ও সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট চলছে। এ থেকে বের হতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
আমদানির জন্য নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি দেশীয় কূপগুলো খননেও জোর দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এসব পরিত্যক্ত কূপে নতুন করে অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। এছাড়াও যে ৪৬টি কূপ ২০২২-২৫ সালের মধ্যে নতুন করে খনন, সংস্কারের কথা ছিল, সেগুলোর সময়ও কমিয়ে এনে একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আগামী ২০২৪ সালের মধ্যেই কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দৈনিক অন্তত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি।
গত বছরের মাঝামাঝি থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত জ্বালানি সংকটে বিপর্যস্ত পুরো দেশ। মে মাসের শেষ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ তীব্র দাবদাহে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন জ্বালানি সংকটে বন্ধ হয়ে যায় দেশের কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। কয়লা সংকটে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় দেশের সবচেয়ে বড় তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা। এতে পুরো দেশে দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয় বিদ্যুৎ বিভাগকে। পরে আবহাওয়ায় কিছুটা শীতলতা এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমতে শুরু করে। তবে পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। চাহিদা বাড়লে আবারও সংকট তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। এতে সাময়িক সংকট মিটলেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান আসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত দেশীয় গ্যাসকূপগুলোতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো না হয়। বিশেষজ্ঞদের এমন সমালোচনার মধ্যেই বাপেক্সের এ পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সাইড লেটার চুক্তির মাধ্যমে এর অতিরিক্ত হিসেবে বছরে আরও এক মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কাতার তাতে সাড়া দেয়নি। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাতার সফরের পরে এ বিষয়ে আসে সুখবর।
চলতি মাসের ১ তারিখ এলএনজি আমদানির জন্য কাতারের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। কাতারের রাজধানী দোহায় এ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৬ সাল থেকে বিদ্যমান চুক্তির আওতায় সরবরাহকৃত এলএনজির বাইরে অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহ করবে কাতার। ১৫ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় ধাপে করা এ চুক্তি ২০২৬-৪০ সাল পর্যন্ত। চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার ও কাতার এনার্জি ট্রেডিংয়ের পক্ষে নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আহমাদ আল হোসাইনি সই করেন। এ চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বিদ্যমান সরবরাহের বাইরে অতিরিক্ত ১২ কার্গো এলএনজি এবং ২০২৭ সালে ২৪ কার্গো এলএনজি (যা কম-বেশি ১ দশমিক ৫ এমটিপিএ এলএনজির সমতুল্য) বাংলাদেশে আসবে।
বাপেক্স বলছে, বর্তমানে দেশে বাপেক্স দৈনিক ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। এছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) উৎপাদন করছে ৬১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড উৎপাদন করছে ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সব মিলিয়ে এই তিন কোম্পানি দৈনিক মোট ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। আর বাকিটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শেভরন আর আমদানি করা এলএনজি। কিন্তু এই উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে আগামী তিন বছর নতুন করে কূপ খনন করা হবে।
বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশীয় কূপ খননে বাপেক্স সব সময়ই আন্তরিক। আমরা চলতি বছরের শেষ বাকি ছয় মাস এবং ২০২৪ সালে ৪৬টি কূপে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করব। তাছাড়া উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করাও হবে। আর সংস্কার করা হবে ১৭টির। বাপেক্সের পাশাপাশি একসঙ্গে কাজ করবে এসজিএফএল এবং বিজিএফসিএল। এতে দেশীয় গ্যাসে একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি।
গত বছরের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে নসরুল হামিদ জানান, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ছিল দৈনিক এক হাজার ৫০২ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমান চাহিদা প্রায় তিন হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সে হিসেবে গত ১৬ বছরে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে দুই হাজার ১৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। একই সময়ে খনিজ তেলের চাহিদা বেড়েছে ৩০ লাখ টন। প্রতিমন্ত্রী জানান, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে খনিজ তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার টন। বর্তমানে চাহিদা প্রায় ৬৩ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে সরকারি ও বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৪ লাখ টন। এছাড়া অন্যান্য উৎস (সরকারি/বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট) থেকে বার্ষিক চার থেকে সাড়ে লাখ টন জ্বালানি পণ্য পাওয়া যায়।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক সংকটের প্রেক্ষিতে পেট্রো বাংলার সূত্র বলছে, এখন দেশে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম এলএনজি আসছে। মূলত কাতার ও ওমানের দুটি কোম্পানি চুক্তির ভিত্তিতে এই এলএনজি সরবরাহ করছে। এর বাইরে স্পট মার্কেট থেকেও কিছু আমদানি করা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে দেশে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসছে দেশী উৎস থেকে। দেশী তিনটি কোম্পানি ৮৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। বাকিটা দিচ্ছে বহুজাতিক দুই কোম্পানি শেভরন এবং তাল্লো।
এ অবস্থায় জোরকদমে খনন কাজ চালাচ্ছে বাপেক্স। বাপেক্সের পরিকল্পনা মোতাবেক ২০২২ সালে ওয়ার্কওভারের কাজ চলছে সেমুতাং-৫ কূপে, ড্রিলিং করা হচ্ছে শ্রীকাইল নর্থ-১এ, সেমুতাং-৬, শরীয়তপুর-১ ও টবগী। ২০২৩ সালে সুন্দলপুর-৩ (ড্রিলিং), মুলাদি/হিজলা-৩ (ড্রিলিং), বেগমগঞ্জ-৪ ওয়েস্ট (ড্রিলিং), ইলিশা-১ (ড্রিলিং), ভোলা নর্থ-২ (ড্রিলিং)-এর কাজ করা হচ্ছে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে সেমুতাং-৭ (ড্রিলিং), দোয়ারাবাজার ইস্ট-১ (ড্রিলিং), জকিগঞ্জ-২ (ড্রিলিং), ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-১ (ড্রিলিং), শাহবাজপুর-৬ (ড্রিলিং), শ্রীকাইল ডিপ-১-এর কাজ চলবে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রীকাইল-৫ (ড্রিলিং), শাহবাজপুর-৭ (ড্রিলিং), ভোলা নর্থ-৩ (ড্রিলিং), মোবারকপুর ডিপ-১-এর কাজ করবে বাপেক্স। এসব কেন্দ্র থেকে অন্তত দৈনিক ২৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হবে।
একইভাবে এসজিএফএল ২০২২ সালে বিয়ানীবাজার-১ (ওয়ার্কওভার) করার পাশাপাশি ২০২৩ সালে কৈলাশটিলা-২ (ওয়ার্কওভার), কৈলাশটিকাল-৮ (ড্রিলিং), রশিদপুর-২ (ওয়ার্কওভার), রশিদপুর-৫ (ওয়ার্কওভার), সিলেট-৭ (ওয়ার্কওভার), রশিদপুর-৯ গ্যাস গ্যাদারিং স্থাপন, সিলেট-১০-এর ড্রিলিং কাজ করা হবে। শুধু তাই নয় এসজিএফএল ২০২৪ সালে রশিদপুর-১১ (ড্রিলিং), রশিদপুর-৩ (ওয়ার্কওভার), রশিদপুর-১৩ (ডিপ-১)-এর কাজ করছে। আর ২০২৫ সালে কোম্পানিটি সিলেট-১১ (ড্রিলিং), বিয়ানীবাজার-২ (ওয়ার্কওভার), ডুপিটিলা-১ (ড্রিলিং)-এর কাজ করবে। এসব কেন্দ্র থেকে ১৬৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। আর বিজিএফসিএল ২০২৩ সালে শুরু করেছে তিতাস-২৪-এর ওয়ার্কওভারের কাজ। একইভাবে তিতাস-৮, তিতাস-১৬ এবং তিতাস-১৪-এর ওয়ার্কওভারেরও কাজ চলছে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে হবিগঞ্জ-৬, বাখরাবাদ-৭ এবং মেঘনা-১-এর ওয়ার্কওভারের কাজ হবে। আর ড্রিলিং হবে তিতাস-(ডিপ-১) এর। একইভাবে ২০২৫ সালে কামতা-২, তিতাস-২৮, তিতাস-২৯, বাখরাবাদ (ডিপ-১)-এর কাজ করা হবে।
নতুন উদ্যোমে কূপ খননের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, তিতাস-২৪নং কূপ থেকে দৈনিক আট মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। বাপেক্সসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবিরাম প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ নিজস্ব জ্বালানি সক্ষমতায় আরেক ধাপ এগিয়ে গেল এতে করে। পরিকল্পনা মতো বাকি কূপগুলোতেও গ্যাস পাওয়ার আশা করছি আমরা। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।