শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে তা হতে পারে বিশ্বের উন্নত দেশের জন্যও অনুকরণীয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ‘ইইউ-বাংলাদেশ কো-অপারেশন : অপরচুনিটিজ অ্যান্ড বেঙ্গল টাইগার ইকোনমি’ শীর্ষক এক যৌথ সম্মেলনে বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। সম্মেলনের যৌথ আয়োজক : ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (ইআইএএস) ও স্টাডি সার্কেল লন্ডন (এসসিএল)। সম্মেলনে বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক বিকাশে উভয় পক্ষ ‘পার্টনারশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট’ (পিসিএ) পৌঁছার লক্ষ্যে আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা খুবই তাৎপর্যময়।
সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব হাসান সালেহ ইইউ ও বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৈশ্বিক রপ্তানির ৫০ শতাংশের লক্ষ্যই ইইউ। ??‘বেঙ্গল টাইগার অর্থনীতি’ হিসেবে গেল ৫০ বছরে নিজের জায়গাও পশ্চিমা বিশ্বে পোক্ত করেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপত্তা, অভিবাসন ও সমুদ্র অর্থনীতি (ব্লু ইকোনোমি) বিষয়ে কাজ করতে চায় এই দুই অংশীদার। যে সম্পর্কের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, লিঙ্গ সমতা, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানও প্রাধান্য পেয়েছে এই আলোচনায়।
সম্মেলনে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কের শিল্প ও অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ গার্মেন্টস শিল্পনির্ভর। যার ৬০ শতাংশই নারী। দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৮.১ শতাংশে পৌঁছায় আর দারিদ্র্য সংখ্যা নেমে আসে ১৯ শতাংশের নিচে। এ সময় তিনি ইইউ-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের গুরুত্বও তুলে ধরেন। দুই বাজারেই কাপড় ও টেক্সটাইল শিল্প লাভবান হচ্ছে বলে জানান তিনি। ইউরোপের বাজারে প্রবেশে বাংলাদেশ আরও আনুকূল্য পাবে বলেও প্রত্যাশা করেন ফারুক হাসান। কৃষি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির পথে হাঁটা বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৩তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলেও জানান তিনি। কার্বন নিঃসরণ কমানো, ভূগর্ভস্থ জলের স্তরের ক্রমহ্রাস রোধ, বিপর্যয়কর রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর মতো সরকারি উদ্যোগগুলোর কথাও তুলে ধরেন বিজিএমইএ সভাপতি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা নিয়ে মূল প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশ : অদম্য উন্নয়ন যাত্রা’ উপস্থাপন করেন স্টাডি সার্কেল লন্ডনের চেয়ারপারসন সৈয়দ মোজাম্মেল আলী। মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বেলজিয়াম সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিরেক্টর জন করনেট ইলজিয়াস, বাংলাদেশের সাবেক সংসদ সদস্য তারানা হালিম, ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশনের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান রেনজি টিরিনক, বাংলাদেশের এমপি নাহিম রাজ্জাক, বেলজিয়াম পার্লামেন্ট সদস্য মিলান জভের। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেমিনারের সভাপতি ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিসের ডিরেক্টর লিল গোথালস। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব দেশের উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কভিড, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব কিছুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অদম্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, এই তলাবিহীন ঝুড়ি ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় দ্রুত সম্প্রসারিত অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২২৭ মার্কিন ডলারে। মাথাপিছু আয় (১৯৪৭ মার্কিন ডলার) এবং অনেক মূল অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও স্টাডি সার্কেলের উপদেষ্টা সুলতান শরীফ, স্টাডি সার্কেল লন্ডনের সমন্বয়ক জামাল খান।