শেষ হয়েও হইলো না শেষ…এবং তামিম ইকবাল নামের ক্রিকেট গল্পটা শেষ না হয়ে কী ভালো যে হলো, তা না বললেও চলে। ভাগ্যিস প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলেন! বোর্ড প্রেসিডেন্ট, টিম ম্যানেজমেন্ট এবং তামিম—তিন পক্ষ মিলে যে জটিল নাটকের অঙ্ক তৈরি হয়েছিল, তা শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই সরল সমাধানে পৌঁছাল। আবেগের বশে নেওয়া অবসরের সিদ্ধান্ত ভেঙে ক্রিকেটে ফিরবেন তামিম। আপাতত ছয় সপ্তাহের ছুটিতে যাচ্ছেন তিনি। এই সময় শারীরিক-মানসিকভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার মাঠে ফিরবেন। বিশ্বকাপে তিনিই দলকে নেতৃত্ব দেবেন।
অবসর ঘোষণার পর আত্মগোপনে ছিলেন তামিম। বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের আগে এমন সিদ্ধান্তে বিব্রত হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্মকর্তারাও। মোবাইল ফোনেও এ ক্রিকেটারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। সহোদর নাফীস ইকবালের মাধ্যমেও তামিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না বিসিবি কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার রাতেই গুঞ্জন রটে, প্রধানমন্ত্রী তামিম ইকবালকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার ফ্লাইটে পরিবার নিয়ে তামিম ইকবাল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। দুপুরে নিশ্চিত হয় এ ক্রিকেটারের গন্তব্য গণভবন। মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার সঙ্গে গণভবনে প্রবেশ করেন তামিম ও তার স্ত্রী আয়েশা ইকবাল। হাজির হন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানও। প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় কাটিয়ে গণভবন থেকে বেরিয়ে আসেন হাসিমুখে।
গণভবন থেকে বের হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে তামিম অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) দুপুরবেলায় আমাকে প্রধানমন্ত্রী তার বাসায় দাওয়াত করেছিলেন। উনার সঙ্গে অনেকক্ষণ আমরা আলোচনা করেছি। উনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন খেলায় ফিরে আসতে। আমি আমার অবসর এই মুহূর্তে তুলে নিচ্ছি। কারণ, আমি সবাইকে না বলতে পারি, কিন্তু দেশের যিনি সবচেয়ে বড় ব্যক্তি, তাকে না বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাতে অবশ্যই পাপন (নাজমুল হাসান) ভাই ও মাশরাফী ভাইয়ের বড় ভূমিকা ছিল। মাশরাফী ভাই আমাকে ডেকে নিয়েছেন। পাপন ভাই সঙ্গে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেড় মাসের জন্য একটা ছুটিও দিয়েছেন। আমি যেন মানসিকভাবে আরেকটু ফ্রি হতে পারি।’
বিসিবি সভাপতি নাজমুল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সংবাদকর্মীদের তিনি বলেছেন, ‘আমার একটা ধারণা হয়েছিল ওর (তামিমের) প্রেস কনফারেন্সটা দেখে, হয়তো আবেগ থেকে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। আমার একটা বিশ্বাস ছিল, তার সঙ্গে যদি সামনাসামনি একবার বসতে পারি, তাহলে হয়তো এটার একটা সমাধান পাব। আজকে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে আমরা সবাই তার সঙ্গে বসেছিলাম এবং ও আপনাদের সামনেই বলে গেল, সে যে অবসরের চিঠিটা দিয়েছে, সেটা সে প্রত্যাহার করছে। সে অবসর নেয়নি।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে অবসর ঘোষণার সময় থেকে গতকাল ক্রিকেটে ফেরার ঘোষণা পর্যন্ত যা ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্দরমহলের কিছু বাজে দিক প্রকাশ হলো। প্রশাসক যারা, তাদের সব কিছুতে নাগ গলানোর উদগ্র বাসনা দেখলাম। ক্রিকেটাররাও (তামিম) পেশাদারিত্ব ভুলে আবেগে ভেসে সিরিজের মাঝখানে অবসর নিয়ে ফেললেন। এর ফলে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হলো, তার সমাধান দিলেন প্রধানমন্ত্রী। বরাবর তিনি এমনটা করে এসেছেন। খেলাধুলা নিয়ে তার আবেগ সর্বজনবিদিত। ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়ও বটে। তা ছাড়া তামিম-সাকিব-মাশরাফী-মুশফিকদের তিনি স্নেহও করেন। সকালে যখন তামিম ঢাকায় রওনা হন, তখনো ধারণা করা যাচ্ছিল প্রধানমন্ত্রীর স্নেহের শাসন এড়াতে পারবেন না তামিম। বাস্তবেও সেটিই ঘটেছে। এজন্য আমাদের ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর বিশাল একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
কিন্তু বারবার কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে। কেনই বা প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে? তাহলে ক্রিকেট প্রশাসকদের কাজ কী? দলে ম্যানেজমেন্টের লোকেরাই বা কী করেন? তামিমের ঘটনায় পরিষ্কার যে, কর্মক্ষেত্রে সীমারেখা মানছেন না ক্রিকেট প্রশাসকরা। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বিস্তৃত হচ্ছে খেলার পরিধি। কিন্তু সমানুপাতিকভাবে বাড়েনি বিসিবির প্রশাসনিক দক্ষতা। লোক দেখানো পেশাদারিত্বের মোড়কে ক্রিকেট পরিচালিত হচ্ছে মূলত আবেগ দিয়ে। ক্রিকেটাররাও সেই আবেগে গা ভাসাচ্ছেন। স্টারডমের সুযোগ নিয়ে কখনো কখনো পেশাদারিত্বের সীমা লঙ্ঘনও করছেন।
সীমারেখা ভুলে গিয়ে টেকনিক্যাল বিষয়, দল নির্বাচন এমনকি একাদশ নির্বাচন নিয়ে ক্রিকেট প্রশাসকদের কথা বলার দৃষ্টিকটু উদাহরণ আমরা লক্ষ করেছি। অন্যদিকে, তারকা ক্রিকেটারদের স্বেচ্ছাচারিতাও দেখা গেছে। নির্দিষ্ট মানদণ্ডে টিম ম্যানেজমেন্ট ক্রিকেটারদের খেলার অনুমতি দেবে। নির্বাচক কমিটি সেই মানদণ্ড স্থির করবে। এ কাজটা সঠিকভাবে করা হলে তো কারোর প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। একাদশে সুযোগ পাওয়া কোনো ক্রিকেটার নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা নেই। তামিমের ক্ষেত্রে যা আমরা দেখলাম, তা চূড়ান্ত অপেশাদারিত্ব ছাড়া কিছু নয়। আশা করা যায়, ছোট এই ধাক্কা ক্রিকেটের অনেক ফাঁকফোঁকর দেখিয়ে গেল। এ থেকে প্রশাসক এবং ক্রিকেটাররা শিক্ষা নেবে। না হলে সবকিছু গুবলেট পাকানোর পর আবার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
খেলার ঘোষণা দিয়ে হুট করে সরে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা বহুল চর্চিত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অতীতে মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এমনটি করেছেন। তাদের দেখানো পথেই হাঁটতে যাচ্ছিলেন তামিম ইকবাল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। নাকি আসতে বাধ্য হয়েছেন। যেটাই হোক, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এটি সুখবর। সেই সুখবরটি নির্মাণের উদ্যোক্তা প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে তামিম সংকট কেটে গেলেও সিনিয়রদের সম্মানজনক বিদায় সংক্রান্ত গুমোট ভাবটা কিন্তু এখনো কাটেনি। অধিনায়কের স্বাভাবিক বিদায়ের ইস্যুটা জাতীয় ফুটবল দলের কোচের মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার চেয়েও বেশি অনিশ্চয়তায় ঢেকে আছে! মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা আনুষ্ঠানিক অবসরের সুযোগ পাননি, নিজ থেকেও সরে দাঁড়াননি নড়াইল এক্সপ্রেস। অবসর ভেঙে ফেরার ঘোষণা দেওয়া তামিম কোন প্রক্রিয়ায় ক্যারিয়ার শেষ করেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়। অন্তত এই নাটকের পর ভালোয় ভালোয় সমাপ্তির আশা ক্রিকেট পাগল জনতা করলে তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। এটুকু আশা পূরণের দায়িত্ব বোর্ডের নেওয়া উচিত।
বিগত দিনে ক্রিকেটের সব ঘটনাবহুল ডামাডোলে বরাবরই পাবলিক সেন্টিমেন্ট ছিল ক্রিকেটারদের পক্ষে। সাম্প্রতিক ঘটনায় অধিকাংশ পাবলিককে পাশে পেয়েছিলেন তামিম ইকবাল। কিন্তু ক্রিকেটারদের এমন হুটহাট সিদ্ধান্তগুলোর কারণে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বদলে যেতে কতক্ষণ। ক্রিকেট প্রশাসকদের যেমন সীমারেখা থাকা উচিত। ক্রিকেটারদেরও কি নিজের আচরণবিধি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত নয়?
সংকটের মেঘ আপাতত কেটে গেছে। কিন্তু তামিম ইকবাল ও ক্রিকেট প্রশাসকদের অতীতের মতো সামনের দিনগুলোতেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বোঝাপড়া নিয়ে কাজ করা উচিত। সে কাজ করতে গিয়ে পেছনের ক্ষোভ-অভিমানে নতুন সংকট তৈরি হলে তা যেন মিডিয়ায় মুখরোচক খবর না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। ক্রিকেটার ও প্রশাসকদের সমন্বিত যৌথ উদ্যোগ ছাড়া কোনো দেশের ক্রিকেট সফল হতে পারে না। দেশের ক্রিকেট থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত জঞ্জাল ছেঁটে ফেলে খেলাকে এগিয়ে নিতে উভয়ের সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।