আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভাবনা এখন শুধুই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ লক্ষ্যে চলছে দলের ইশতেহার তৈরির কাজ। নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আশঙ্কা করে আওয়ামী লীগ তৃণমূলের সব শাখার সম্মেলন সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যাতে দ্রুত শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা করছে সরকার। তৈরি হয়েছে ভোটার আকৃষ্ট করার জাতীয় বাজেট। ভোটারদের কাছে পৌঁছতে নজর দিচ্ছে দলটি।
এই লক্ষ্যে সারা দেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয়গুলোয় স্থাপন করা হচ্ছে স্মার্ট কর্নার। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের সাফল্য ও অর্জন তুলে ধরতে সেপ্টেম্বর থেকে গণসংযোগও করবে ক্ষমতাসীনরা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বিএনপি একদফার আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও সরকার তাদের ছাড় দিতে নারাজ। এ কারণে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে।
সর্বশেষ ২২ জুন অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠন গোছানোর জন্য কঠোর নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হবে। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে জানিয়ে তিনি দলীয় সংসদ-সদস্যদের ঢাকায় না থেকে নির্বাচনি এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের প্রস্তুতি চলছে। ইশতেহার প্রণয়নের কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এখন চলছে দল গোছানোর কাজ। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেই কাজটি করছেন। অন্যান্য কার্যক্রমও স্বাভাবিক গতিতে চলছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সব কার্যক্রমই এখন নির্বাচনমুখী। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী যে কর্মসূচি পালন করা হয়, সেখানেও নির্বাচনের বিষয় ছিল। সামনে সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভাগীয় সমাবেশ রয়েছে। এ সমাবেশগুলোয় মূলত বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি নির্বাচনের বিষয়ে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। আর সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে নির্বাচনের বিরতিহীন প্রস্তুতি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, যেখানে জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা হবে। চারটি মূল স্তম্ভের ভিত্তিতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে-স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট অর্থনীতি। আওয়ামী লীগের ঘোষণায়ও একই কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প সামনে রেখে আমরা (আওয়ামী লীগ) নির্বাচনি কৌশল প্রণয়ন করছি। এবারের বাজেটেও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি রয়েছে। আমরা মনে করি, গত প্রায় ১৫ বছরে সারা দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তাই দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নতুন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন অব্যাহত রাখবেন। এ সময় তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগ শাসনামলের সব উন্নয়ন প্রকল্পের উল্লেখ থাকবে, যাতে দেশের মানুষের কাছে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছায়।
দলীয় সূত্র জানায়, গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সামনে রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় একে কৌশল হিসাবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের টানা তিন সরকারের শাসনামলে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকার মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেলসহ দেশে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প হয়েছে, সেসব কাজ এবং নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রচারণা চালিয়ে সরকারের প্রতি জনসমর্থন আদায় করার চেষ্টায় এই কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরাসরি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করে আসছেন। এসব অনুষ্ঠানে বিপুল জনতার উপস্থিতি দেখা গেছে। তিনি ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ধরনের উদ্বোধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন প্রকল্প উদ্বোধন কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্বাচন পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় জনসংযোগ কার্যক্রম চলবে। একই সঙ্গে বিভাগীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে জনমত তৈরিতে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কাজের প্রচার চালানো হবে। এ কর্মসূচিতে সরকারের আমলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র বা অর্জন তুলে ধরে মানুষকে বোঝানো হবে যে আওয়ামী লীগের আমলে কী কী বাস্তব সুফল দেশের মানুষ পেয়েছে।
জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোয় স্থাপন করা হচ্ছে স্মার্ট কর্নার। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। ১৩ জুন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রথম ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সহায়তায় প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সঙ্গে যুক্ত সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার।
দলটির একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, স্মার্ট কর্নারের কার্যক্রম হিসাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার প্রস্তুতির অংশ হিসাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকার তালিকা করা হবে। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের ভার্চুয়াল যোগাযোগ তৈরি এবং অনলাইন প্রচারণায় স্থানীয়দের সমন্বয় করা হবে।
এ বিষয়ে কবীর বিন আনোয়ার বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যম হবে স্মার্ট কর্নার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্মার্ট কর্নারের মাধ্যমেই সারা দেশে প্রচারণা টিম ম্যানেজমেন্ট করা হবে। প্রতিটি ভোটারের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের বার্তা পৌঁছাতে স্মার্ট কর্নার হবে একটি কার্যকরী মাধ্যম।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের সাফল্য ও অর্জন তুলে ধরতে সেপ্টেম্বর থেকে গণসংযোগ শুরু করবে আওয়ামী লীগ। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণায় তরুণ সমাজকে সম্পৃক্ত করতে সারা দেশে ‘ছাত্র-যুব সমাবেশ’ করার পরিকল্পনাও নিয়েছে দলটি। এ বিষয়ে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বুধবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে ঢাকা মহানগর শাখা ও সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় গঠনমূলক তথ্য-উপাত্ত সহকারে বিএনপিসহ বিরোধীদের অভিযোগ এবং মিথ্যাচারের জবাব দেওয়ার জন্য দলীয় নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।