১৭ বছর পর মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন ছাইদুল শেখ। ভাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে নেমে হকচকিয়ে যান। যাবেন ভাঙ্গা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ছিলাধরচর গ্রামে। বাস থেকে নেমে নিজের এলাকাকেই চিনতে পারছিলেন না! ঢাকা থেকে ভাঙ্গা আসার সময় আগে মাওয়া ঘাটেই কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এবার বিমানবন্দর থেকে মাত্র দুই ঘণ্টায় পৌঁছে গেছেন ভাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে। আসার পথে নবনির্মিত এক্সপ্রেসওয়ে আর ভাঙ্গার অত্যাধুনিক সড়ক সংযোগ (ইন্টারসেকশন) তাঁকে চমকে দিয়েছে। কিছুই চিনতে পারছিলেন না তিনি। মনে হচ্ছিল এক মালয়েশিয়া থেকে নতুন আরেক মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছেন তিনি।
দেশকে জোড়া লাগাচ্ছে ‘ভাঙ্গা’
ধূলি-কাদা আর ভাঙাচোরা সড়কের পুরোনো ভাঙ্গা আর নেই। পদ্মা সেতু, সংযোগ সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন রেললাইন ও স্টেশন এবং ইন্টারসেকশনের কারণে পুরোপুরি বদলে গেছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা। পুরোনো ভাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড যারা দেখেছেন, তাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে নতুন ভাঙ্গা। উন্নয়নের আয়োজনে রাতারাতি বদলে গেছে ভাঙ্গা। আশপাশের জেলার মানুষ এখন ভাঙ্গায় বেড়াতে আসছেন। ইন্টারসেকশনে গিয়ে ছবি তুলছেন সপরিবারে। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই নান্দনিক ও উঁচু মডেল মসজিদ। স্থানীয় মুসল্লিরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন সেখানে। পর্যটকদের আনাগোনায় ভাঙ্গায় নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বেশ কয়েকটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টও খোলা হয়েছে ভাঙ্গা সদরে। কোনো কোনোটিতে বিনিয়োগ করেছেন প্রবাসীরা। সেখানে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন এলাকার যুবক ও তরুণরা। ভাঙ্গার ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে।
ভাঙ্গা গোলচত্বরের কাছেই নতুন চালু হয়েছে ঝলমলে একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁ। লাগোয়া মিনি শিশু পার্কে শিশুদের নিয়ে আসছেন বাবা-মায়েরা। এই প্রতিষ্ঠানের প্রবাসী মালিক বললেন, ‘সেই দিন কি আর আছে? এই উপজেলাকে কেন ভাঙ্গা নামে ডাকা হয়? দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশ শেষ হয়েছে এখানে।’ ভাঙ্গা এখন দেশকে জোড়া লাগাচ্ছে। ভাঙ্গা এখন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগস্থল। এতদিন এদিকে পদ্মা, ওদিকে যমুনা নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন ছিল বিরাট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক-সংযোগ স্থাপন করেছে এই উপজেলাটি। ভাঙ্গা গোলচত্বর থেকে ফরিদপুর জেলা সদর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, মেহেরপুর, নড়াইল ও রাজবাড়ী জেলায় যাতায়াত করা যাচ্ছে খুব সহজে।
যেহেতু ২১টির মতো জেলায় যাতায়াতের সুযোগ রয়েছে, তাই এই মোড় ঘিরে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের চাপও বেশি। সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন ব্যবসা এবং এর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসা ও পেশার কাজের সুযোগ।
গোলচত্বরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত এক রেস্তোরাঁর মালিক দুবাই প্রবাসী লিটন শেখ সমকালকে বলেন, ‘একটি সড়কের মোড় এত সুন্দর হতে পারে!’ লিটন শেখ এই সড়ককে দুবাই শহরের এক্সপ্রেসওয়ের মোড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত মাত্র ৫৫ কিলোমিটার পথ হচ্ছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। এশিয়ান হাইওয়ের করিডোর-১-এর অংশ এই সড়কটি।
সরেজমিন দেখা গেল, পদ্মা সেতু হয়ে প্রতিদিনই ভাঙ্গা গোলচত্বরের এমন বদলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে ও উপভোগ করতে ছুটে আসছেন আশপাশের জেলা ও উপজেলাসহ দূর-দূরান্তের বাসিন্দারা। ঢাকা থেকেও আসছেন অনেকে।
নতুন স্বপ্ন দেখছেন স্বল্প আয়ের মানুষ
ভাঙ্গা গোলচত্বরে প্রায় ১৫ বছর ধরে হালিম বিক্রি করছেন পশ্চিম হাসামদিয়ার বাসিন্দা শেখ মোহসীন। মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কসংলগ্ন পৌরসভার বটতলার মোড়ে দেখা যাবে তাঁর দোকানটি। পদ্মা সেতুর কারণে ভাঙ্গা গোলচত্বরের বদলে যাওয়ার গল্প তাঁর জীবনকেও বদলে দিচ্ছে। কয়েক বছর আগেও এই ব্যবসা করে তাঁর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। এখন প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার হালিম বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত স্থানীয়সহ দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে বেড়াতে এসে তাঁর দোকানে হালিম খেতে ভিড় জমায়। এ থেকেই তাঁর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে। মোহসীন জানান, তিনি এ ব্যবসা করে তাঁর এক ছেলেকে ইউরোপে পাঠিয়েছেন, দুই মেয়েকে সামাজিকভাবে ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে, তাঁর ছোট ছেলেটি ভাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। তাকে নিয়েও মোহসীনের অনেক বড় স্বপ্ন। তাঁর জীবনে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য তিনি এ অঞ্চলের উন্নয়নকেই সব কৃতিত্ব দেন।
ভাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের কয়েকজন শ্রমিক ও অটো, মাহেন্দ্র ও ভ্যানচালকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কয়েকজন সমকালকে বলেন, কয়েক দিন আগেও ঠিকমতো ভাড়া গাড়ির কিস্তি তারা সময়মতো পরিশোধ করতে পারতেন না। যাত্রীর অভাবে ঠিকমতো আয়-উপার্জন হতো না। তবে পদ্মা সেতুর পাশাপাশি ভাঙ্গা গোলচত্বরটি হওয়ায় দূর-দূরান্তের যাত্রী বহন করেই তাদের সেই অর্থনৈতিক কষ্ট অনেকটাই বর্তমানে লাঘব হয়েছে। সারাদিনে যে কোনো এক বেলা ভ্যান-অটো চালিয়ে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত উপার্জন খুব সহজেই করতে পারছেন। গাড়ির কিস্তিও পরিশোধ করতে পারছেন।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। ভাঙ্গায় একটি জংশনসহ ঢাকার কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, মাওয়া, শিবচর ও সিরাজদীখানের নিমতলায় একটি করে স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে নতুন আরও এক দিগন্তের উন্মোচন হবে বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেলসহ এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে শুধু ভাঙ্গা নয়, এর আশপাশে গোটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন আসবে বলেও মন্তব্য করেছেন ভাঙ্গার বড় ব্যবসায়ীরা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পণ্য পরিবহনের সময় কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের অর্থনীতিও গতি পাবে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান, নির্মাণ করা হচ্ছে শপিংমলসহ হোটেল-মোটেল। স্থানীয়রা মনে করেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ অঞ্চলটিকে শিল্প ও পর্যটনের গন্তব্য হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব।
ভাঙ্গা উপজেলা বিখ্যাত কুমার নদের পাড়ে অবস্থিত। কথিত আছে, কুমার নদের পাড়ে কুমারগঞ্জ নামে এক বিরাট হাট বসত। কোনো এক সময় এই হাটকে কেন্দ্র করে কুমার নদের এপার-ওপারের লোকজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগে এবং দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে ওপারের লোকজন কুমারগঞ্জের হাট ভেঙে নতুন হাট চালু করে। নতুন চালু করা হাটকে ‘ভাঙ্গার হাট’ ডাকতে ডাকতে এলাকার নাম হয়ে যায় ‘ভাঙ্গা’। সেই কুমার নদে রাতের এক্সপ্রেসওয়ের ঝলমলে আলোর মালার ছায়া পড়ে।