অবশেষে ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহার করে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছে বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই বাণিজ্যের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। নতুন এই ব্যবস্থা চালুর ফলে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।
প্রথম দিন দুই কোটি ৮০ লাখ রুপি লেনদেনের মধ্যে দিয়ে আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়েছে।
প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ থেকে রুপিতে রপ্তানি চালান পাঠিয়েছে বগুড়ার তামিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। এই চালানের মূল্য এক কোটি ৬০ লাখ রুপি। রপ্তানিকারকের ব্যাংক ছিল স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) বাংলাদেশ শাখা। আর তা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলেছে ভারতের আইসিআইসিআই ব্যাংক।
তামিম অ্যাগ্রোর চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান আলী অনুষ্ঠানে অতিথিদের কাছ থেকে রপ্তানি নথি গ্রহণ করেন। জানা গেছে, তামিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ২০১৮ সাল থেকে ভারতে রাইস ব্র্যান অয়েল রপ্তানি করে আসছে। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১৬৩ কোটি টাকা এবং তার আগের বছর ১৫৪ কোটি টাকা রপ্তানি আয় করে।
অন্যদিকে রুপিতে প্রথম আমদানি করেছে নিটল-নিলয় গ্রুপ।
তাদের আমদানি চালানের মূল্য ১০০ কোটি রুপি। আমদানির ঋণপত্র খোলে এসবিআইয়ের ঢাকা অফিস। অনুষ্ঠানে আমদানি নথি গ্রহণ করেন নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ। এই আমদানির এলসি খুলেছে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক। অন্যদিকে রপ্তানিকারকের ব্যাংক ছিল ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংক।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি বাণিজ্য রুপিতে হলে রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। ডলারের ওপর চাপ কমাতেই দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা করে আমরা এই পথে গেছি।’ রুপিতে লেনদেনের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করে আগামী সেপ্টেম্বরে টাকা-রুপি লেনদেনে বিশেষ কার্ড আনার কথাও জানান তিনি। টাকা-রুপি লেনদেনে কার্ড প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘টাকা-রুপিতে আমরা ডুয়াল কারেন্সি কার্ড চালুর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। সেপ্টেম্বরে এটি চালু করা যাবে। এই কার্ড দেশে যেমন ব্যবহার করা যাবে, তেমনি ভারতে গিয়েও ব্যবহার করা যাবে।’
ডলার সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে এই কার্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যায়, তারা সঙ্গে মার্কিন ডলার নিয়ে যায়। ভারতে যাওয়ার পর সেই ডলার রুপিতে রূপান্তর করে খরচ করতে হয়। নতুন এই কার্ড চালু হলে আর দুইবার মুদ্রা বিনিময় করতে হবে না। কার্ড ব্যবহার করলে বিনিময় হারের খরচ কিছুটা বাঁচবে। এই কার্ড দেশে যেমন ব্যবহার করা যাবে, তেমনি ভারতে গিয়েও ব্যবহার করা যাবে।
গভর্নর আরো বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশ বছরে এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। আর রপ্তানি করে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য। দীর্ঘদিন ধরেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে রুপিতে বাণিজ্যের আলোচনা চলছিল। ব্যবসায়ীরাও এর দাবি করে আসছেন অনেক দিন ধরে। এবার তা বাস্তব রূপ পেল।
রুপিতে লেনদেনকে দুই দেশের অংশীদারির নতুন সূচনা বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দূরদর্শী নেতৃত্বে গত এক দশকজুড়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটেছে। এই রূপান্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ হলো দুই দেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ।
এটা দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকারের নিদর্শন। দুই দেশের প্রসারমাণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে রুপিতে লেনদেন শুরু হলো। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের অনেক দিন ধরে দাবি ছিল রুপিতে লেনদেনের; আজ সেটা পূরণ হলো এবং তাঁরা অনেক খুশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, গত পাঁচ বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে, সমন্বিত অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে ভারত এখানে ভূমিকা রাখতে চায়। এটা (রুপিতে বাণিজ্য) একটা উদ্ভাবনী উদ্যোগ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অর্থনীতির জন্যই শুধু ইতিবাচক নয়, ব্যবসায়ীদের লেনদেনকে আরো সহজ করবে। লেনদেনের খরচই শুধু কমবে না, কম সময়ে লেনদেনে ঝুঁকিও কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে আরো উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
এই লেনদেন শুরু হওয়ার পর রপ্তানি আয় বাবদ যে পরিমাণ রুপি আসবে, সমপরিমাণ আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারবে ব্যাংক। আবার স্বল্প মেয়াদে রুপি ঋণ নিয়ে আমদানি করা যাবে। এতে ডলারের ওপর সৃষ্ট চাপ সাময়িকভাবে কমবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের সোনালী, ইস্টার্ন এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন করতে পারবেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। ভারত অংশে এসম্পর্কিত বিষয়ের দায়িত্বে থাকবে দেশটির আইসিআইসিআই ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। রুপিতে লেনদেনের চাহিদা বাড়লে পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংককেও অনুমতি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিঞা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মো. সলিমুল্লাহ, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম, ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলি রেজা ইফতেখার, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ এবং বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আলোচনা চলছে প্রায় এক দশক ধরে। বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে। সে সময় ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
রপ্তানিতে খরচ কমবে, সময়ও বাঁচবে : এদিকে ভারতের সঙ্গে রুপিতে আমদানি-রপ্তানি করা শুরু হওয়ায় ট্রানজেকশন ফি বাবদ বাড়তি টাকা দিতে হবে না; বাড়তি সময়ও ব্যয় হবে না। টাকা থেকে সরাসরি রুপিতে ট্রান্সফার হবে। এর ফলে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে খরচ কমবে, সময়ও বাঁচবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাহ উল হক। তিনি বলেন, রুপির বিনিময় হার নির্ধারণে দুই দেশের ডলারের বিনিময় হারের গড়কে ভিত্তি হিসেবে নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, ২২টি দেশের সঙ্গে ভারত রুপিতে বাণিজ্য শুরু করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ১৯তম দেশ।