সরকার এবার বঙ্গোপসাগরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায় খুঁজছে। এ জন্য এরই মধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সাগরে সম্ভাব্যতা যাচাই জরিপ শুরু হয়েছে। আর এই যাচাইয়ের ফল ইতিবাচক হলে সমুদ্রের মধ্যবর্তী এলাকায় বায়ুবিদ্যুৎ টারবাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। সাগরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য এরই মধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জরিপকাজ শুরু হয়েছে।
এর ফলাফল আগামী দু-এক মাসের মধ্যে পাওয়ার কথা। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি তিন প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম সাগরে বায়ুকল স্থাপনের জন্য ১৩০ কোটি ডলারের একটি বিনিয়োগ প্রকল্প সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বর্তমানে দেশে বায়ুবিদ্যুতের ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণাধীন ও পরিকল্পনাধীন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন রয়েছে কক্সবাজারে ২টি ও মোংলায় ১টি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প। এ ছাড়া পরিকল্পনাধীন অবস্থায় পটুয়াখালী, চাঁদপুরের কচুয়াসহ বিভিন্ন এলাকা মিলিয়ে বায়ুবিদ্যুতের আরও পাঁচটি প্রকল্প পর্যায়ক্রমে নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে আছে। তবে পুরনো বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ আছে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এবং ফেনীর সোনাগাজীতে ছোট আকারের দুটি প্রকল্প আগে শুরু হলেও বর্তমানে এগুলো বন্ধ আছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বড় আকারের বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই নদী বা সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে। আগামীতে সমুদ্রের তীর থেকে দু-চার কিমি গভীরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ খুঁজছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে জমি-স্বল্পতার কারণে সাগরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ ছাড়া স্থলভাগ থেকে সাগরে বাতাস বেশি হওয়ায় সেখানে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা বেশি। তবে পরিবেশ, মাছের বংশবিস্তার-চলাচল-আহরণ এবং জাহাজ চলাচলে যেন ক্ষতি না হয় তা বিবেচনা করেই এ ধরনের বায়ুকলগুলো স্থাপন করা হবে। এ জন্য সাগরের তলদেশ টারবাইন স্থাপনে উপযোগী কি না এবং কেন্দ্রের কাছাকাছি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ-সম্প্রসারণের উপযোগিতাও বিবেচনা করা হবে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, ‘বর্তমানে সাগরে আমাদের বায়ুবিদ্যুৎ স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জরিপকাজ চলছে। যখন এটি ফিজিবল হবে তখন তা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে কি না এবং মাছের বিচরণক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়ে কি না তা বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আবার যারা সরকারের কাছে এই প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে তারাও এর সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। স্থলভাগের চেয়ে বাতাস বেশি থাকার কারণে সাগরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা বেশি। আশা করছি দু-এক মাসের মধ্যেই আমরা সাগরে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ফলাফল হাতে পাব।’ বিদ্যুৎ বিভাগ সাগরের মধ্যভাগে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে। এগুলো হলো ইতালির সিইএসআই, নেদারল্যান্ডের বিক্স এবং বাংলাদেশের সাইনোটেক ও এসএস সল্যুশনস। চলতি বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই এবং বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। ১০ মাসের মধ্যে যাচাই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য সরকার ২৩ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছে। সাগরের মাঝে বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সম্ভাব্যতা যাচাই বিষয়ে চলতি বছর পয়লা মার্চ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জানানো হয়, প্রকল্পটি দুই পর্বে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই অংশে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে সাগরে ব্লক চিহ্নিত করা হবে। আর বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় সাগরে চিহ্নিত করা হবে অন্তত দুটি স্থান, যে স্থানগুলো থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা গ্রিডে বা গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যাবে। এরই মধ্যে সাগরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে যৌথভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে ডেনমার্কের দুটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি। বঙ্গোসাগরের মধ্যে বায়ুকল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের কাছে গত মাসে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছে তিন কোম্পানি নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রস্তাবে। এ জন্য ১৩০ কোটি ডলার (প্রায় ১৪ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করা হবে। এই কনসোর্টিয়ামে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ইনফ্রাস্টাকচার পার্টনারস (সিআইপি) ও কোপেনহেগেন অফশোর পার্টনারস (সিওপি) এবং বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ। চলতি মাসে প্রকল্প প্রস্তাব বিষয়ে প্রস্তাবক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটিই হবে বাংলাদেশে প্রথম সাগরে বায়ুকল নির্মাণ প্রকল্প। প্রস্তাবিত বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জীবনকাল প্রাথমিকভাবে ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এসট্রোপ পিটারসনও সাগরে ৫০০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।