বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন করা হতে পারে আগামী ৩ অক্টোবর। সব কিছু ঠিক থাকলে এদিনই ফিতা কাটা হবে এদেশের এভিয়েশন খাতের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পের। এ দিনটিকে ধরেই চলছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। বেবিচক জানিয়েছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই উদ্বোধনের বিষয়টি ইতোমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ ধরেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যে যতটা সম্ভব কাজ সারিয়ে নেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চলছে। দিন-রাত বিশাল কর্মযজ্ঞকে ত্বরান্বিত করতে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গেই সচেষ্ট রয়েছেন। আমাদের টার্গেট প্রাথমিক উদ্বোধনের দিনের আগেই সর্বোচ্চ পরিমাণের কাজ সারিয়ে নেওয়া। যাতে দেশবাসী সত্যিকার অর্থেই তাদের স্বপ্নের থার্ড টার্মিনালই দেখতে পান। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে অবশ্যই স্মার্ট এভিয়েশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। থার্ড টার্মিনাল, কক্সবাজার ও সিলেট বিমানবন্দরের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ এখন সমাপ্তির পথে। এদের মধ্যে সবার আগেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে থার্ড টার্মিনাল।
সম্প্রতি কাজের গতি-প্রকৃতি সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ৩ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত কি কি করা যাবে কি করা যাবেনা সেটাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। দুপুরের দিকে গিয়ে দেখা যায়, দোতলায় বিশাল এলাকাজুড়ে ফলস সিলিংয়ের কাজ চলছে। বিমানবন্দরের সামনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে যাতে অতিথিরা সরাসরি থার্ড টার্মিনালে ঢুকেই অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছতে পারে এ সংক্রান্ত সব ধরনের কাজ দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। শত শত শ্রমিক কর্মচারী দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজে নিয়োজিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক জানান, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যেদিন উদ্বোধন করা হবে সেদিন পর্যন্ত থার্ড টার্মিনালের মোট কাজের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন হয়ে যাবে। তারপর বাকি থাকবে শুধু যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ।
জানা গেছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কমপক্ষে ১৫শ’ অতিথি আপ্যায়নের লক্ষ্য নিয়েই চলছে আনুষঙ্গিক কাজ। এ দিন অন্তত দুটি বোর্র্ডিং ব্রিজ চালুর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। টার্মিনালের সর্ব দক্ষিণ ও পূর্ব প্রান্তের এ দুটির একটিতে বোর্র্ডিং ব্রিজে সংযুক্ত থাকবে বিমানের সুপরিসর বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর প্লেন। এখানেই যাত্রীদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের ফ্লাইটে নেওয়ার পর নতুন ট্রেক্সিওয়ে দিয়ে ফ্লাইট রানওয়ের দিকে যাবে। এভাবেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছক সাজানো হচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ছাড়াও নির্মাণ সংস্থা এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের বিপুল সংখ্যক অতিথি অংশ নেবেন। তারা তাদের বিশাল এই কর্মযজ্ঞের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা তুলে ধরবেন।
উদ্বোধনের দিন আগত অতিথিরা কি কি দেখতে পাবেন জানতে চাইলে বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, এমনিতে বাইর থেকে দেখলে সবার চোখেই পড়বে কাজ শেষ। অর্থাৎ বহিরাংশের সব কাজই শেষ হয়ে যাবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের আগেই। কিন্তু তখনো ভেতরের কিছু ফিনিশিং বাকি থাকবে। এর মধ্যে কিছু যন্ত্রপাতির সংযোজন বিশেষ করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের কাজ চলবে।
তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থে প্রকল্পের শেষ মেয়াদ হচ্ছে ২০২৪ সালের এপ্রিল। সেই হিসেবে আমরা তার প্রায় ৭ মাস আগেই এটি উদ্বোধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা নিশ্চিত আগামী এপ্রিলের আগে অবশ্যই এ প্রকল্পের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, দেশের বিমানবন্দরের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারিত তৃতীয় প্রকল্প, যা থার্ড টার্মিনাল হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বর্তমানে প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এই দুটি টার্মিনাল একলাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। আর থার্ড টার্মিনালে রয়েছে- দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা। বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত এই বিমাবন্দরের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এটির কাজ আগামী বছরে শেষ হওয়ার সিডিউল থাকলেও চলতি বছরের অক্টোবরেই প্রাথমিক পর্ব শেষে উদ্বোধনের লক্ষ্যে তোড়জোড় চলছে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে এখানে। এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে জাপানের মিৎসুবিশি ও ফুজিটা এবং কোরিয়ার স্যামসাং এই তিনটি প্রতিষ্ঠান থার্ড টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ করছে। থার্ড টার্মিনালের নক্সা করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি রোহানি বাহারিন, যিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালের নক্সা করে বিশ্বে খ্যাতি কুড়িয়েছেন।
ইতোমধ্যে থার্ড টার্মিনালের ৭২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখানে থাকছে ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং। অর্থাৎ একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে চারটি ট্যাক্সিওয়ে আছে। নতুন করে আরও দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সে জন্য নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন। এখানে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ। প্রথম ধাপে চালু করা হবে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ।
থাকবে উড়োজাহাজ রাখার জন্য ৩৬টি পার্কিং বে। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেক ইন কাউন্টার থাকবে। এ ছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ থাকবে ৬৬টি ডিপার্চার ইমিগ্রেশন কাউন্টার। আগমনের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেক ইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। এর বাইরে টার্মিনালে ১৬টি আগমনী ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে মাল্টি লেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে এক হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন। এখন অবকাঠামো কাজের শেষে যেসব যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, সেগুলো স্থাপন করা হবে। থার্ড টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ ও উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে, যার মাধ্যমে মেট্রো রেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ ব্যবস্থা থাকবে। এতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। থার্ড টার্মিনালে স্বতন্ত্র কোনো ভিভিআইপি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে না। তবে টার্মিনাল ভবনের ভেতর দক্ষিণ পাশে সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ভিভিআইপিদের সময় কাটানোর জায়গা থাকবে।
প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে থার্ড টার্মিনালেই স্মার্ট এভিয়েশনের সব সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। যেমন- এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, পূূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা, অটোমেটেড রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট, অ্যাডভান্সড পাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের মতো সব ধরনের ব্যবস্থা থাকছে থার্ড টার্মিনালে। এ ছাড়া অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম সংবলিত এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ঢাকা থেকে কন্ট্রোল করা হলেও সারাদেশের অন্য এয়ারপোর্টগুলোও এতে সংযুক্ত থাকবে। এরপর ধাপে ধাপে অন্যান্য এয়ারপোর্টেও একই সিস্টেম চালু করা হবে। এভাবেই দেশের বিমানবন্দরগুলোকে স্মার্ট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলেই স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা হবে।