আমদানিনির্ভর জ্বালানি তেল এখনো সনাতন পদ্ধতিতে খালাস করা হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে নোঙর করে রাখা তেলের জাহাজগুলো থেকে ছোট লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে তেল খালাস করা হয়। এতে অতিরিক্ত সময়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
তাই অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে জাহাজ থেকে তেল খালাস করার জন্য কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে নোঙর করে রাখা জাহাজ থেকে দ্রুত, ব্যয়সাশ্রয়ী, সুষ্ঠু, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে তেল খালাস করা সম্ভব। এতে একদিকে যেমন সময় কম লাগবে, তেমনি খরচও কম হবে। শুধু তাই নয়; খালাসকৃত তেল স্টোরেজ ট্যাংকে মজুত করে রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। এই মজুতকৃত তেল সংকটকালে জ্বালানি খাতের চাহিদা ও জোগানে সহায়ক হিসেবে কাজে আসবে।
গভীর সমুদ্রে ডাবল পাইপলাইনের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে হাতে নেয় সরকার। বর্তমানে প্রকল্পের ৯৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের শেষের দিকে প্রকল্পটি চালু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এই প্রকল্পে মহেশখালী দ্বীপে স্থাপন করা হয়েছে পৃথক পৃথক ক্রুড ও ডিজেল স্টোরেজের ট্যাংক। আর এসপিএম বয়া স্থাপন করা হয়েছে মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরে। যেখানে বিদেশ থেকে তেল এনে নোঙর করে রাখে বড় বড় জাহাজ। এই বয়া সংলগ্ন জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এনে জমা রাখা হবে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে। পরবর্তীতে স্টোরেজ ট্যাংক থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী ক্রস করে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভেতর দিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে পাঠানো হবে। সেখান থেকে বিভিন্ন কোম্পানির স্টোরেজ ট্যাংকে জমা করে সারাদেশে সাপ্লাই করা হবে।
প্রকল্প কর্মকর্তা মনজেদ আলী শান্ত জনকণ্ঠকে বলেন, কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের নাব্য কম এবং চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে বড় বড় তেলের জাহাজগুলো ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। এসব তেলের জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করে রাখে এবং ছোট ছোট লাইটার জাহাজের মাধ্যমে তেল খালাস করা হয়। এভাবে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন তেল খালাস করতে ১১ দিন সময় লেগে যায়। এ ছাড়া এভাবে তেল খালাস করা ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। তাই প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকারভিত্তিতে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১১ দিনের জায়গায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন খালাস করা সম্ভব হবে। এতে সরকারের বছরে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তিনি জানান, জাহাজ থেকে তেল স্টোরেজ ট্যাংকে আনতে ১২০ করে মোট ২২০ কিলোমিটারের ডাবল পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৬ কি.মি. পাইপ সমুদ্রের ভেতরে আর ৭৪ কি.মি. স্থলে। এখানে ব্যবহার করা পাইপগুলো মেটালসহ উন্নতমানের। যা লিকেজ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। লিকেজ হলেও আগে সংকেত আসবে।
মহেশখালী দ্বীপে স্থাপন করা এসপিএম স্টোরেজ ট্যাংকে গত শুক্রবার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১৯১ একর জমিতে গড়ে উঠেছে প্রকল্পটি। প্রকল্পের মোট ৬টি স্টোরেজ ট্যাংকের মধ্যে ৩টি ক্রুড অয়েল (প্রতিটির নেট ধারণক্ষমতা ৫০ হাজার ঘন মিটার) ও ৩টি ডিজেল ট্যাংক (৩০ হাজার ঘন মিটার) রয়েছে। স্টোরেজ ট্যাংকগুলো সমতল থেকে প্রায় ২০ ফিট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে বন্যা কিংবা বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্টোরেজ ট্যাংকে পানি উঠতে না পারে। এসপিএম থেকে ৩৬ ব্যাসার্ধের ২টি পৃথক পাইপলাইন গিয়ে মিলিত হয়েছে গভীর বঙ্গোপসাগরের বয়াতে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা এই উপজেলায় প্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। তাই প্রায় দেড়শ’ বছরের আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে এখানে স্টোরেজ ট্যাংকগুলো স্থাপন করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি হওয়ায় স্থানীয় অনেকে এখানে চাকরি পেয়েছেন। এতে বেকারত্বের অনেকাংশে দূর হয়েছে।