দেশের অর্থনীতির জন্য ‘গেম চেঞ্জার’ হতে যাওয়া মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের চূড়ান্ত নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে ২০২৪ সালের শুরুতে। এরই মধ্যে সিভিল ওয়ার্কস ফর পোর্ট কনস্ট্রাকশন, কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট টিওএস অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম টাগ বোট, সার্ভে বোট এবং পাইলট বোট ক্রয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে চূড়ান্ত মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে, যা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে।
গভীর এ সমুদ্রবন্দর পুরোদমে চালু হলে দেশের আয় হবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। আমদানি-রপ্তানি খরচ কমবে ৩০ শতাংশ। আমদানি-রপ্তানির সময় কমবে ১০ থেকে ১৪ দিন।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আগামী বছরের শুরুতে ভূমি উন্নয়নসহ অন্যান্য কাজ শুরু হবে। আশা করছি ২০২৬ সালের মধ্যেই পুরোদমে চালু হবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর।’ তিনি বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু না হলেও এরই মধ্যে কয়লা নিয়ে জাহাজ নোঙর শুরু হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের যন্ত্রপাতি নিয়ে অন্যান্য জাহাজও নোঙর করবে।’ জানা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালীর বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় ১৪০০ একর লবণভূমিতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন প্রথম দফায় ৪০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আরও ১ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জরিপের কাজ চলছে, যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করে বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হবে। এরই মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরে যাতে নির্বিঘ্নে ১৬ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ ভিড়তে পারে এ জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেল। এ চ্যানেল ব্যবহার করে ২৫ এপ্রিল মাতারবাড়ীতে নোঙর করে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ পানামার পতাকাবাহী ‘অউসো মারু’। ২২৯ মিটার দীর্ঘ এবং সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজটিতে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৬৫ হাজার মে টন কয়লা আনা হয়। এরপর ওই চ্যানেল ব্যবহার করে কয়লা নিয়ে মোট ছয়টি জাহাজ নোঙর করে মাতারবাড়ীতে।
গভীর সমুদ্রবন্দরকে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে তৈরি করা হয়েছে ঢেউনিরোধক বাঁধ। চ্যানেলের গভীরতা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য ড্রেজিংয়ের কাজ চলমান। লবণভূমিকে বন্দরে রূপান্তর করতে এরই মধ্যে সিভিল ওয়ার্কস ফর পোর্ট কনস্ট্রাকশনের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। এ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন শেষ পর্যায়ে। একইভাবে ‘কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট টিওএস অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম টাগ বোট’ টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত মূল্যায়ন চলছে। ‘সার্ভে বোট ও পাইলট বোট’ টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, যার মূল্যায়ন চলছে। বন্দর-সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। আগামী বছরের শুরুতেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। এটি চালু হলে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানিতে পরিবহন ব্যয় ৩০ শতাংশ কমবে। সময় সাশ্রয় হবে ১০ থেকে ১৪ দিন। এতে দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশ এ বন্দর ব্যবহার করার কারণে দেশেরও আয় হবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।’ দেশের অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’ মনে করা হচ্ছে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরকে। গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে ট্রানজিট ভোগান্তি ছাড়াই ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে দেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহনের জন্য তৃতীয় কোনো দেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে হয়। তৃতীয় দেশ হয়ে আমদানি-রপ্তানি করার কারণে একদিকে পরিবহন ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমন আমদানি-রপ্তানিতে সময় বেড়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে সরকার মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে মাতারবাড়ীকে অত্র অঞ্চলের বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা বন্দর গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরাসরি পণ্য পরিবহন করবে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ বন্দর ব্যবহার করবে। এতে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব, যা ছাড়িয়ে যাবে সিঙ্গাপুরকে।