যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতকে গতকাল বুধবার বিকেলে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে এই রাষ্ট্রদূতরা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, রাষ্ট্রদূতদের সামনে কূটনৈতিক রীতিনীতি ও শিষ্টাচার সম্পর্কিত ভিয়েনা কনভেনশনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁদের বলা হয়েছে, যে আইন অনুযায়ী তাঁরা এ দেশে কূটনৈতিক মর্যাদা পাচ্ছেন, সেই আইন অনুযায়ী তাঁরা কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না তা স্পষ্ট করা আছে।
গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে ভোট শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম।
গত ২০ জুলাই বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সরকারের অসন্তোষ জানানো হয়।
রাষ্ট্রদূতদের মূল্যায়ন বস্তুনিষ্ঠ নয়
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘হিরো আলমকে নিয়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি দূতাবাস কূটনৈতিক রীতিনীতি ভেঙে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। ওই দূতাবাসগুলোর রাষ্ট্রদূতদের আমরা ডেকেছি। তাঁদের কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণে আমরা আমাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছি।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, হিরো আলমের ওপর হামলা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটি দিয়ে সারা দিনের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। এই উপনির্বাচনে সহিংসতা হয়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম সারা দিন বিভিন্ন কেন্দ্র অবাধে বিচরণ করে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভোট শেষ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনিও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হননি বা কোনো অভিযোগ করেননি। অন্য প্রার্থীরাও কোনো ধরনের সহিংসতা বা অন্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ করেননি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু একটি কেন্দ্রে শেষ মুহূর্তের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাটিকে গুটিকয়েক কূটনীতিক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা কখনোই সারা দিনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের চিত্রকে প্রতিফলিত করে না। দ্রুত একটি প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের মূল্যায়নের বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেননি।’
কূটনীতিকদের আহ্বান অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘটনা সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও সরকার ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। গত ১৯ জুলাই কূটনীতিকদের বিবৃতি দেওয়ার অনেক আগেই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও তাঁরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের ওই আহ্বানকে অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
যৌথ বিবৃতির উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, যে দ্রুততার সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির সমালোচনা করেছেন, সেই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু সরকারের নেওয়া তাত্ক্ষণিক ও ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থার কোনো মূল্যায়ন তাঁরা করেননি। তাই যৌথ বিবৃতিটির বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়।’
যা বলেছেন রাষ্ট্রদূতরা
সরকারের বক্তব্যের জবাবে রাষ্ট্রদূতরা কী বলেছেন, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাঁদের মধ্যে চার-পাঁচজন কথা বলেছেন। তাঁরা (রাষ্ট্রদূতরা) মূলত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যে এটি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করা হয়নি। তাঁরা আমাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করার জন্য করেছেন। তাঁরা মনে করেছেন, এটি আমাদের সঙ্গে তাঁদের অব্যাহত সম্পৃক্ততার অংশ।’
রাষ্ট্রদূতদের যুক্তি খণ্ডন
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রদূতরা যুক্তি দেখালে সরকারের পক্ষ থেকে তা খণ্ডন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি ভিয়েনা কনভেনশনে পরিষ্কার বলা আছে, কোনো রাষ্ট্রদূতের প্রথম যোগাযোগের মাধ্যম হওয়া উচিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের কথা ও যোগাযোগকে সরকার সব সময় প্রশংসা করে। কিন্তু কোনো বিষয়ে তাঁদের উচিত হলো প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানানো। রাষ্ট্রদূতরা যে ঠিক কাজটি করেননি তা বোঝাতেই এটি বলা হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে ছিলেন বিজয়ী প্রার্থী
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্রিফিংয়ের একটি অংশে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী মোহাম্মদ এ আরাফাতও উপস্থিত ছিলেন। তিনিও হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা এবং হামলাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ককে তলবের কারণ
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার রাষ্ট্রদূতদের একসঙ্গে ডেকে পাঠানোকে তলব বলছেন না। তবে আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ককে তলব করেছিলাম। এর কারণ হলো জাতিসংঘের কমিটির অনুমোদন ছাড়া জাতিসংঘের কর্মকর্তা এ ধরনের কাজ করতে পারেন না।’
রীতিনীতির বাইরে গিয়ে কেন রাষ্ট্রদূতরা এমন বিবৃতি দিচ্ছেন, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের প্রচেষ্টা থেকে এটি হয়ে থাকতে পারে। আবার কারো অতি উৎসাহের কারণেও এটি হয়ে থাকতে পারে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের ক্ষেত্রে এটি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।’
রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের আচরণ মিলছে না
রাষ্ট্রদূতরা কি তাঁদের রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করেন এবং সরকারের এমন প্রতিক্রিয়ায় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না, জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রদূতদের অকূটনৈতিকসুলভ আচরণ নিয়ে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে ওই দেশগুলোতে লিখিত বার্তা পাঠানো হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ওই দেশগুলোর সম্পর্কে নতুন করে টানাপড়েনের কোনো কারণ দেখছেন না। কার্যকর সম্পর্কে এ ধরনের ইস্যু থাকলেও বন্ধুত্ব এগিয়ে যেতে পারে এবং যায়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত বছরের শেষ দিকে এশীয় একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশের রাষ্ট্রদূতের বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এর আগেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো একটি দেশের রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছিলেন। সেটি তাঁর দেশের মন্তব্য ছিল না। এ কারণে আমরা তাঁকে তলব করেছিলাম। এরপর সেই দেশের সঙ্গে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফর বিনিময় হয়েছে। অতি সম্প্রতি সফর হয়েছে। আমরা দুই দেশের নাগরিকদের নতুন নতুন সম্ভাবনা উপহার দিয়েছি।’