রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতা বরদাশত করবে না সরকার। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে—এমন কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করা হবে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সরকারের এই মনোভাবের কথা জানানো হয়েছে। দেওয়া হয়েছে যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার বার্তা। পাশাপাশি যে কোনো ধরনের ‘বিশৃঙ্খলা’ ঠেকাতে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দলীয়ভাবেও মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বিনিয়োগ পরিবেশ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের দমন ও গ্রেপ্তারের একটা পরিবেশ তৈরি করতে চাচ্ছে। ‘পায়ে পাড়া দিয়ে’ সমাবেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে সংঘাতময় করতে উসকানি দিচ্ছে।
এদিকে আজ শুক্রবার মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্বে রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশ এবং আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী সংগঠনের শান্তি সমাবেশ ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিন হলেও সড়কগুলো ছিল অনেকটা ফাঁকা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, কয়েকদিন ধরেই সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠক থেকে সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে পুলিশকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। আগ বাড়িয়ে কিছু না করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, কেউ যদি বিশৃঙ্খলা করতে চায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করতে চায়—তাহলে তা শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। পাড়া-মহল্লায়, আবাসিক হোটেল ও সন্দেহজনক এলাকাগুলোতে নজরদারি করতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মসূচি পালন করবে। এখানে সরকারের দিক থেকে কোনো বাধা নেই। কিন্তু জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে, জানমালের ক্ষতি করলে, ভাঙচুর করলে, জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলে, শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করলে, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কথা হলো, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সব সময় প্রস্তুত আছে। যদি কেউ ঝামেলা করে, তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠে নেমেছে। বিভিন্ন সন্দেহভাজন আবাসিক হোটেল, বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। রাজধানী ও আশপাশের এলাকাগুলোতে চেকপোস্টও জোরদার করা হয়েছে। গত দুই দিনে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃণমূল এবং মধ্যম সারির নেতারা রয়েছেন গ্রেপ্তারের তালিকায়।
আজ শুক্রবার দুদলের কর্মসূচি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপির কর্মসূচি থেকে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা করা হলে শক্তভাবে তা প্রতিরোধের মনোভাব রয়েছে। বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি রাজধানীজুড়ে আনসার সদস্য ও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য মোতায়েন থাকবেন। পুলিশ বাহিনীকে সহায়তার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের। পরিস্থিতির প্রয়োজনে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নামানোর প্রস্তুতি রয়েছে। পুলিশের রায়ট কার, জলকামানসহ সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিএনপিকে নয়াপল্টনে পুলিশ হাসপাতাল মোড় থেকে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত সড়কে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও এর চারপাশেই থাকবে পুলিশের বলয়।
মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমিউনিটি পুলিশ ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার নির্দেশনা রয়েছে। বিট পুলিশ কর্মকর্তাদের সক্রিয় হয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে, যাতে কোনো বাসাবাড়িতে সন্দেহভাজন বা অপরিচিত, কোনো অপরাধী অবস্থান করতে না পারে। পাশাপাশি পুরোনো মামলার আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা রয়েছে।
ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তাদের মাঠে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারা নিজ নিজ এলাকায়, পাড়া-মহল্লায় সতর্কদৃষ্টি রাখছেন, যাতে কোনো কর্মসূচির নামে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় কোনো ধরনের সন্দেহভাজন ব্যক্তি অবস্থান করতে না পারে। এমন সন্দেহভাজন কিছু দেখলে স্থানীয় থানা পুলিশকে অবহিত করা হচ্ছে।
ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, আবদুল্লাহপুর, গাবতলী ও বাবুবাজার এবং এর আশপাশে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সূত্র বলছে, সব সময়েই প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট থাকে। তবে পবিত্র আশুরার নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির নিরাপত্তার স্বার্থে শুক্রবার সারা দিন এসব চেকপোস্টে নজরদারি থাকবে বেশি।
গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘এমনিতে বড় কোনো আশঙ্কা নেই। তবে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ঘিরে যে কেউ বাইরে থেকে এসে, কোনো কুচক্রী মহল বা অন্য কেউ কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। কাজেই সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে চেকপোস্ট এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও নিয়মিত মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করতে হয়। এটা নিয়মিত অভিযানের অংশ। এটা আগেও করা হয়েছে, এখনো করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘বড় দুই দলের সমাবেশের সুযোগ নিয়ে কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। এজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত পুলিশ থাকবে, র্যাব থাকবে, আনসার থাকবে, এপিবিএন থাকবে এবং বিজিবি স্ট্যান্ডবাই থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে।’
হঠাৎ করে চেকপোস্ট বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দিনে-রাতে চেকপোস্ট আছে। এখন মহররমের তাজিয়া মিছিল চলছে। ২০১৫ সালে সেখানে জঙ্গি হামলা হয়েছিল। দুটি বড় দলের সমাবেশ রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে চেকপোস্ট কার্যক্রম চলছে।’
অন্যদিকে সরকারদলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ ঢাকাজুড়ে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। মহানগরীর প্রবেশপথগুলোর আশপাশের থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতারা বরাবরের মতো সতর্ক অবস্থানে থাকবেন। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করা হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ কালবেলাকে বলেন, ‘কেউ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার দায়িত্ব পালন করবে। তবে দলীয়ভাবেও সতর্কতামূলক অবস্থান থাকবে। কাউকে শান্তি বিনষ্ট করতে দেওয়া হবে না।’
এদিকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশকে সরকার সংঘাতময় করে তুলছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সমাবেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে পায়ে পাড়া দিয়ে নষ্ট করার জন্য সরকার উসকানি দিচ্ছে। বুধবার থেকে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হচ্ছে। হোটেলে হোটেলে তল্লাশি করছে। এরা কি বেআইনি লোক? এরা কি অপরাধী? এরা বিভিন্ন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, দল ও অঙ্গসংগঠনের জেলা পর্যায়ের নেতা।’
রিজভী বলেন, ‘দলীয় কার্যালয়ের আশপাশের হোটেলগুলোতে পুলিশ গত রাতে হানা দিয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে অনেককে। এটা কি কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ হলো? এটা কি কোনো সভ্য আচরণ হতে পারে?’
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কাউকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে না। তবে আশুরা ও বড় দুই দলের সমাবেশের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন মামলার আসামি বা ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এটা নিয়মিত কাজ ।’