মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের সৌন্দর্য, স্থিতি ও শান্তি নির্ভর করে মানুষের পারস্পরিক আচরণ, চিন্তা ও নৈতিকতার ওপর। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- হিংসাবিদ্বেষ, পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতার মতো আত্মঘাতী ব্যাধি সমাজের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়ে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিনিয়ত বিপন্ন করে তুলছে। নৈতিক অবক্ষয়ে অশান্ত হচ্ছে সমাজের প্রতিটি অঙ্গ। ইসলাম এসব অনৈতিক প্রবণতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং এগুলোকে ব্যক্তি ও সমাজ ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
হিংসা নেক আমল ধ্বংসকারী আগুন : হিংসা হলো অন্যের কল্যাণ সহ্য করতে না পারা এবং তার নিয়ামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার কামনা করা। কোরআনে আল্লাহতায়ালা হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে’ (সুরা ফালাক : ৫)। রসুলুল্লাহ (সা.) হিংসার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, ‘হিংসা থেকে দূরে থাকো; কেননা হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমন আগুন শুকনো কাঠকে ভস্ম করে দেয়’ (আবু দাউদ)। হিংসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়, ন্যায়বোধ নষ্ট করে এবং সমাজে বিভেদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। হিংসার কুফল হিসেবে মানুষ একাকিত্ব, অশান্তি ও আল্লাহর অসন্তুষ্টির সম্মুখীন হয়।
বিদ্বেষ-হৃদয়ের বিষ : বিদ্বেষ বা অন্তরের শত্রুতা মানুষের আত্মাকে বিষাক্ত করে। এটি সম্পর্ক ভাঙে, বিশ্বাস নষ্ট করে এবং সহিংসতার পথ উন্মুক্ত করে। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না’ (সুরা আল-হুজরাত : ১০)। নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ রেখো না, পরস্পর থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করো না; বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাও’ (সহিহ মুসলিম)। বিদ্বেষের সমাজ কখনো শান্তিপূর্ণ হতে পারে না; কারণ বিদ্বেষ মানুষের হৃদয় থেকে মানবিকতা কেড়ে নেয়। মানবিকতা ও আন্তরিকতার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে পরম সৌভ্রাতৃত্ব। নিঃস্বার্থভাবে উপকার করা শেখায়। উদ্বুদ্ধ করে সমাজে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতি। অন্যদিকে বিদ্বেষ মানুষকে হিংসা শেখায়। অন্তর অন্ধ করে দেয় এবং সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে। কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘শয়তান তো তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায়’ সুরা আল মায়েদা-৯১)। বিদ্বেষ মানুষকে পরনিন্দা, অন্যায় ও জুলুমের দিকে ঠেলে দেয়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর বিদ্বেষ করবে না, একে অন্যের প্রতি শত্রুতা পোষণ করবে না’ (সহিহ মুসলিম)।
পরনিন্দা-মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ : পরনিন্দা বা গিবত যেমন একটি গুনাহ ও মহাপাপ, তেমনিভাবে এটি সামাজিক বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কোরআনে এর তুলনা করা হয়েছে জঘন্য এক অপরাধের সঙ্গে; ‘তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা ঘৃণা করবে’ (সুরা আল-হুজরাত : ১২)। রসুলুল্লাহ (সা.) গিবতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে, এটাই গিবত। যদি তার মধ্যে এই দোষ থাকে তা হলো গিবত, আর যদি তা না থাকে তাহলে তা হবে অপবাদ’ (সহিহ মুসলিম)। পরনিন্দা সমাজে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও শত্রুতার বীজ বপন করে, যা শেষ পর্যন্ত শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করে।
পরশ্রীকাতরতা-কৃতজ্ঞতার অভাব : পরশ্রীকাতরতা মানুষকে অন্যের উন্নতি সহ্য করতে দেয় না। এটি আল্লাহর ফয়সালার ওপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ যা কাউকে বেশি দিয়েছেন, তা নিয়ে কামনা করো না’ (সুরা নিসা : ৩২)। পরশ্রীকাতর মানুষ কখনো অন্তরে শান্তি পায় না এবং সমাজকে ও অশান্ত করে তোলে। ইসলাম এসব ধ্বংসাত্মক প্রবণতার পরিবর্তে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচার ও আত্মীয়কে দানের নির্দেশ দেন’ (সুরা নাহল : ৯০) রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা ভালোবাসে, তা তার ভাইয়ের জন্যও ভালোবাসে’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতা ব্যক্তিচরিত্রকে যেমন কলুষিত করে, তেমনি সমাজের শান্তিশৃঙ্খলাও ধ্বংস করে দেয়। কোরআন-সুন্নাহের আলোকে এসব ব্যাধি থেকে আত্মশুদ্ধি অর্জনই-পারে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে। ব্যক্তি যদি নিজেকে সংশোধন করে, তবেই সমাজে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। চলমান বাংলাদেশে হিংসা-বিদ্বেষ পরনিন্দা পরশ্রীকাতরতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষভাবে আসন্ন নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে তা আরও মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হবে। অতএব সবাইকে এসব নিন্দনীয় অপরাধ ও গর্হিত আচরণ পরিহার করে শান্তির পথ অবলম্বন করতে হবে।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা
প্রকাশক : সোহেল রানা সম্পাদক: আব্দুস সামাদ সায়েম
©২০১৫-২০২৫ সর্বস্ত্ব সংরক্ষিত । তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত (নিবন্ধন নং-২১০)