সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন

ইউরোপে ফল ও সবজির বাজার প্রসারিত হচ্ছে

রিপোর্টারের নাম / ১৪৩ বার দেখা হয়েছে
আপডেট করা হয়েছে বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ১:০৭ অপরাহ্ন

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভরাটিয়া গ্রামের তাপস সরকার। পেঁপে, কাচকলা, পটোল, কচুর লতিসহ অনেক ধরনের সবজি চাষ করেন তিনি। স্থানীয় বাজারে আগে বিক্রি করে কখনো লাভ হতো, কখনো বা লোকসানে পড়তেন। কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে ২০২১ সাল থেকে ইতালিতে সবজি পাঠাতে থাকেন ঢাকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। তিনি এখন লাভবান। তার দেখাদেখি এলাকার আরো অনেকেই কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে আসছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শর্তানুযায়ী গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস বা গ্যাপ অনুসরণ করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে হয়। আবার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে প্যাকেজিং করে তা পাঠাতে হয়। রফতানিকারকরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে উদ্বুদ্ধ করে ফল ও সবজি উৎপাদন করছেন। এতে স্থানীয় কৃষি বিভাগও পাশে দাঁড়িয়েছে। খুলনা, যশোর, নরসিংদী, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, যশোর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষকেরা সবজি ও ফল উৎপাদন করছেন। তাদের কাছ থেকে নিয়ে রাজধানীর শ্যামপুরস্থ প্যাকিং হাউজের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলোতে ফল ও সবজি রফতানি করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে কৃষকেরা যেমন ভালো দাম পাচ্ছেন, ব্যবসায়ীরাও লাভবান হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপে বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ফল ও সবজির বাজারে অপার সম্ভাবনা। এ দু’টি কৃষিপণ্য রফতানি করতে হলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই শর্তজুড়ে দেয়ার পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ২০১২-২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ১৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ নির্মাণ করা হয়। সেখানে ল্যাবের যন্ত্রপাতিও আনা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ মে ইউরোপে আম রফতানির জন্য এই ল্যাব আংশিকভাবে চালু করা হয়। তবে দক্ষ জনবলের অভাবে ফল ও সবজি মোড়কজাত করার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এই প্যাকিং হাউজটি পুরোদমে চালু করা যায়নি। যাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তারাও বদলি হয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যান। ফলে কোনো মতে চলতে থাকে ল্যাবের কার্যক্রম। যেহেতু ইউরোপের বাজারে ফল ও সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, তাই ২০২১ সালের জুন থেকে ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির পরিচালক ড. জগৎ চাঁদ মালাকার জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে স্থাপিত এই ল্যাবটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রায় বেশির ভাগই সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্যাকিং হাউজের কাজ শেষ হওয়ার কথা। সবকিছু ঠিক থাকলে এর আগেই সেটা শেষ হতে পারে বলে আশা করছি।

কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশে^ তৃতীয়; কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং পেঁপে উৎপাদনে তৃতীয়। দেশে বছরে সবজি উৎপাদন হয় প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টন এবং ফল উৎপাদন হয় প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে অনেক ফল ও সবজি অতিরিক্ত থাকে বা নষ্ট হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশী ফল ও সবজির বড় বাজার রয়েছে।

ডিএইর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্যাপ মেনে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের দেশগুলোতে ফল ও সবজি রফতানি হচ্ছে। বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইউরোপে সবজি রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৩০৭ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১৩ টনে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে হয়েছে ১ হাজার ২০৭ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফল রফতানি হয়েছে ১ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা হয়েছে ৩ হাজার ১৯৯ টন। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তা হয়েছে ১ হাজার ৬৫৯ টন। সবচেয়ে বেশি রফতানি হচ্ছে যুক্তরাজ্যে। ৫২ ধরনের সবজি রফতানি হচ্ছে ইউরোপে। আর ফল রফতানি হচ্ছে ৪২ ধরনের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কৃষিপণ্য রফতানি করতে হলে অনেক নিয়ম ও ধাপ মেনে কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে হয়। গ্যাপ মেনে কৃষিপণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি বাধ্যতামূলক। তাই নতুন আঙিকে রাজধানীর শ্যামপুরস্থ কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

এই প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে গত মঙ্গলবার সরেজমিন রাজধানীর শ্যামপুরস্থ কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা ভবনটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। উন্নত টাইলস বসানো হয়েছে হাউজের চার পাশে। নতুন করে নির্মাণ হয়েছে সীমানা প্রাচীর। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে সুসজ্জিত অফিস কক্ষ। সবকিছুতেই বেশ যতেœর ছাপ। প্যাকিং হাউজের নিচতলায় সবজি ও ফলমূলের মান যাচাই-বাছাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া ও শুকানো এবং মোড়কজাত করার জন্য আলাদা আলাদা অত্যাধুনিক কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। দোতলায় একই ব্যবস্থা আছে। দোতলায় পণ্যবাহী ট্রাক ওঠার জন্য আলাদা র‌্যাম্প করা হয়েছে। আছে ২০০০ কেজি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কার্গো লিফট। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্য নিচতলা ও দোতলায় রয়েছে কয়েকটি কুলিং কক্ষ। ভবনের তৃতীয় তলায় কর্মকর্তাদের জন্য কার্যালয়, রফতানিকারকদের প্রশিক্ষণের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশাল আধুনিক প্রশিক্ষণকক্ষ ও একটি সভাকক্ষ আছে। এ ছাড়া নির্মাণ হচ্ছে ১০টি ল্যাব। সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরও আছে, রয়েছে নিজস্ব পাওয়ার স্টেশনও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. বাদল চন্দ্র বিশ^াসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তারা কাজের মানে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা এও জানিয়েছেন, প্যাকিং হাউজটি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাব রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া তাদের আবাসন সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধাও বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু আধুনিক ল্যাব ও প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, এমন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যারা প্যাকিং হাউজে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারবে। তার জন্য রাখতে হবে নানা সুবিধা। প্রয়োজনে আলাদা কোয়ারেন্টিন কর্তৃপক্ষ করারও দাবি উঠেছে।

এ বিষয়ে শ্যামপুর প্যাকিং হাউজের অতিরিক্ত উপপরিচালক এসএম খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, আমদানিকারক দেশগুলো কৃষিপণ্য নিতে গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস-জিএপি (গ্যাপ) অনুসরণের শর্ত দিচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো ইতোমধ্যে এই শর্ত দিয়েছে। অন্য দেশগুলোও গ্যাপ অনুসরণে গুরুত্ব দিচ্ছে। কন্ট্রাক্ট ফার্ম বা চুক্তিবদ্ধ কৃষকের কাছ থেকে ফল ও সবজি সংগ্রহ করে যথাযথভাবে মোড়কীকরণের পর তা বিদেশে পাঠানোর জন্য দরকার আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবরেটরি। কিন্তু বাংলাদেশে এটি এখনো অনুপস্থিত। প্যাকিং হাউজটি পুরোদমে চালু হলে রফতানির বাজারে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।
কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার জানান বিদেশের বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এখন যেসব পণ্য যাচ্ছে তার বেশির ভাগের ক্রেতা বাংলাদেশী। বিদেশীদেরও আমরা ক্রেতা বানাতে চাই। এজন্য আমাদের আন্তর্জাতিকমানের ল্যাব দরকার। শ্যামপুরে সেটা হচ্ছে। এ ছাড়া পূর্বাচলেও একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব হবে। শ্যামপুরে ফাইটোসেনেটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় যে ল্যাবটি ছিল সেটাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রকল্প এগিয়ে চলছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
Theme Created By Limon Kabir