♦ ২০২৫ সালের মধ্যে খনন করা হবে ৪৬টি কূপ ♦ সাগরে অনুসন্ধানে গতি ফিরছে চূড়ান্তের পথে সংশোধিত পিএসসি ♦ অনুসন্ধান চালানো হবে পার্বত্য এলাকায়
দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের জ্বালানি বিভাগ দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান বাড়াতে তোড়জোড় শুরু করেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা দেশি উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন ধরে বলে এলেও বাস্তবে এ কাজে উল্লেখ করার মতো কোনো গতি ছিল না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাগরে ও স্থলে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অনেকটা থমকে ছিল, যা সাম্প্রতিক সময়ে এসে আবার কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি গ্যাসকূপ খননের কাজ শুরু করেছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি আনতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য আকর্ষণীয় উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) সংশোধন প্রক্রিয়ার কার্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। পিএসসি চূড়ান্ত হতে সর্বোচ্চ আর মাসখানেক লাগতে পারে। এ ছাড়া সমুদ্রের পাশাপাশি স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পার্বত্য এলাকার ১০টি স্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ২০২৫ সাল পর্যন্ত যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) তাদের গ্যাসক্ষেত্রে পাঁচটি আর সিলেট গ্যাসফিল্ডস কোম্পানি (এসজিএফএল) একটি কূপ খননের কাজ করছে। চলতি বছরের মধ্যে বাপেক্সের পাঁচটি, এসজিএফএলের ছয়টি এবং বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডস কোম্পানির (বিজিএফসিএল) চারটি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এই ১৫ কূপে দৈনিক ২১.৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির আশা করছে পেট্রোবাংলা। আগামী বছর (২০২৪) বাপেক্স ছয়টি, বিজিএফসিএল চারটি এবং এসজিএফএল চারটি কূপ খনন করতে পারে। এতে ওই বছর দিনে ১৭.৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। ২০২৫ সালে বাপেক্স চারটি, বিজিএফসিএল চারটি এবং সিলেট গ্যাসফিল্ডস তিনটি কূপ খনন করবে। এতে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ১৬.৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের (বিজেএফসিএল) নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষেত্রগুলোতে চার বছরে (২০২২-২০২৫) ১২টি কূপ খনন করা হবে। এতে গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে ১৭ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাসে সাতটি কূপ খনন করা হবে। বাকি পাঁচটি খনন করা হবে বাখরাবাদ-১, কামতা-১ ও ২, মেঘনা ও হবিগঞ্জ-৬। সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের আওতায় থাকা ক্ষেত্রগুলোয় ১৪টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে সংস্কার কূপ আছে আটটি, বাকি ছয়টি অনুসন্ধান কূপ। কৈলাসটিলা, বিয়ানীবাজার, রশীদপুর ও সিলেট ক্ষেত্রগুলোতেও কূপ খনন করা হবে। এগুলো দেশের পুরনো গ্যাসক্ষেত্র। এতে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া রশীদপুর-১৪, কৈলাসটিলা-৯ ও বাতচিয়া-১ এ উত্তোলন কূপ এবং রশীদপুর-৭ ও কৈলাসটিলা-১ ও ৩-এ দুটি ওয়ার্কওভার কূপ খনন করা গেলে অন্তত ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৫ সালেও দেশীয় কূপগুলো থেকে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে এখন দৈনিক দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ২২০০ থেকে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে। এ সময়ের মধ্যে গ্যাসের চাহিদা দ্বিগুণ হয়েছে। সরকার গ্যাসের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে এ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার প্রায় আট মাস এ গ্যাস আমদানি বন্ধ রাখে। বিভিন্ন কারণে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি না থাকায় এখন সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে আগ্রহী। সরকারের জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা গ্যাস উৎপাদনে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ জন্য স্থলভাগে অনুসন্ধানের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রেও গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে। নতুন পিএসসি সংশোধন হলেই দরপত্র আহ্বান করা হবে। বিদেশি কোম্পানিগুলো যাতে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় তা মাথায় রেখে মডেল পিএসসি ২০১৯ (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) সংশোধন করা হচ্ছে। নতুন পিএসসিতে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে ওঠানামা করবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পেট্রোবাংলা ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ৪৬টি কূপ খননের মাধ্যমে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ৬২ কোটি ঘনফুট বৃদ্ধি করতে চায়। একটি কূপ খনন করতে খরচ হয় দেড় শ থেকে দুই শ কোটি টাকা। তবে এ সময়ের মধ্যে বাপেক্স একা সব কূপ খনন করতে পারবে না। সর্বোচ্চ ১৯ থেকে ২০টি কূপ বাপেক্স খনন করতে পারবে। আর বাকিগুলো বাইরের অন্য কোনো কোম্পানি দিয়ে তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে খনন করিয়ে নিতে হবে। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে বাপেক্সকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর। আবার বাপেক্সকে রিগ কিনে এনে কূপ খনন করতে হলে আমাদের আরও বাড়তি পাঁচ বছর সময় অপেক্ষা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘পিএসসি এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এখন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি অনুমোদন করলেই আমরা প্রজ্ঞাপন করে ফেলব। সে ক্ষেত্রে পিএসসি চূড়ান্ত হতে সর্বোচ্চ আর এক মাস লাগতে পারে। আশা করছি চলতি বা আগামী সপ্তাহেই এটি পাঠানো হবে। আর এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে সেভাবেই আমরা বিডিংয়ে যাব।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের জানান, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি চাহিদা পূরণে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ভোলার গ্যাস দ্রুত সঞ্চালন নেটওয়ার্কে আনা হবে। গভীর সমুদ্রে ও ভোলার আশপাশের নদীতেও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, মার্কিন কোম্পানি এক্সন মোবিল সমুদ্রে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ জন্য জ্বালানি বিভাগে কোম্পানিটি লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছে। বিদেশি কোম্পানি শেভরন বিবিয়ানার অনাবিষ্কৃত অংশে একটি অনুসন্ধানী কূপ খননের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। আর ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসির চলতি বছর অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর দুটো অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা। সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপ চীনের সিনোপ্যাক কোম্পানির খনন করার কথা। বাপেক্সের শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব-১ কূপ খননের প্রস্তুতি চলছে। জানা যায়, গত এক বছরে একটি অনুসন্ধান এবং একটি উন্নয়ন ও ৫ ওয়ার্কওভার কূপের মাধ্যমে ৩ থেকে ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়েছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে সিলেট ৯ নম্বর কূপে নতুন গ্যাস মিলেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ-৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্কওভারে ১.৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। কৈলাশটিলা-৭ কূপ থেকে ১ কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। শ্রীকাইল-৪ নম্বর কূপ থেকে ২ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ক্ষেত্র আবিষ্কার, বিদ্যমান ক্ষেত্রের মজুদ ও নতুন স্তরে অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ কার্যক্রম চালাচ্ছে বাপেক্স। বর্তমানে ব্লক ১৫ ও ২২-এর আওতাধীন ফেনী ও চট্টগ্রামে টুডি সাইসমিক সার্ভের কাজ চলছে। নভেম্বরে ব্লক-৬বি ও ১০-এর আওতায় বরিশাল-চাঁদপুর অঞ্চলে গ্যাসের খোঁজে টুডি ভূকম্পন জরিপ চলবে। সিলেটের জকিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের পাথারিয়ায় চলতি বছর ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ কার্যক্রম চালাবে বাপেক্স। একই সঙ্গে বাপেক্স পার্বত্য অঞ্চলের ১০টি স্থানে গ্যাস-খনিজ অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির (আইওসি) সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য তিন পার্বত্য জেলার ১০টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।