‘ কথিত’ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি,জুলুমবাজের রোল মডেল,বহুমাত্রিক দূর্ণীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষতায় থাকার ঘোষণা দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশের দীর্ঘসময় বিশ্বের নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে, এরপর ভারতের গণমাধ্যম ও ভারত-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলো দেশকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করতে শুরু করে।
অপপ্রচারের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক বা অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন, এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের পটভূমি বা কার্যকলাপকে অবমূল্যায়ন করা। সংবেদনশীল গণমাধ্যম, বিশেষত ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত সংবাদ মাধ্যমগুলো অভ্যুত্থানটিকে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান (তাদের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে) এবং চীন দ্বারা কথিত পরিকল্পিত ইসলামপন্থী সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল।
পটভূমি:
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের কার্যকর গণ–অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তিনি ভারতে পালিয়ে যান। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বহুবার অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষতির বিনিময়ে ভারতের স্বার্থে কাজ করেছেন। হাসিনার বিদায়ের পরপরই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে।
অপতথ্য:
হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা,শেখ হাসিনার বিদায়ের পর, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বরাত দিয়ে মিথ্যা দাবি করে যে, এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী হিন্দু ভারতে আশ্রয়ের জন্য পালাচ্ছে, এবং বাংলাদেশকে “ইসলামী রাষ্ট্র” হিসেবে পরিণত হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।একটি মিথ্যা প্রতিবেদনে দাবি করা হয় বাংলাদেশী ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে, যা পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়। লিটন দাস নিজেই একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এই দাবি অস্বীকার করেন। বিভিন্ন টেলিভিশন সংবাদ চ্যানেল মিথ্যা শিরোনাম ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সহিংসতাকে “গণহত্যাযজ্ঞ” হিসেবে দাবি করে; এছাড়াও আ-লীগের একটি অফিসে ঘটা অগ্নিসংযোগকে নিকটস্থ হিন্দু মন্দিরে কথিত অগ্নিসংযোগের ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়।অসংখ্য ভারত-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট #AllEyesOnBangladeshiHindus ও #SaveBangladeshiHindus নামক হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বাংলাদেশী হিন্দুদের ওপর হামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ভিডিও ও ছবি প্রচার করে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি তথ্য-যাচাই কারী সংস্থা এই দাবিগুলো ভুয়া প্রমাণিত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে প্রতিবেদন:
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ভারতীয় সংবাদপত্র দি ইকোনমিক টাইমস এর সম্পাদক দীপঞ্জন রায় চৌধুরী একটি মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন,যাতে বলা হয় ইউনূস সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিষিদ্ধ ইসলামী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে আলম তার যাচাইকৃত ফেসবুক পাতায় বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, তিনি কখনোই উক্ত সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন না এবং সব সময় তাদের মতাদর্শের বিরোধী। তিনি প্রতিবেদনটিকে ভারতীয় গণমাধ্যমের “উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার” হিসেবে চিহ্নিত করেন।
৬ নভেম্বর ২০২৪ রিপাবলিক বাংলা একটি মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে, যেখানে সংবাদ উপস্থাপক দাবি করেন ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। এরপর চ্যানেলটির জ্যেষ্ঠ সম্পাদক অনির্বাণ সিনহা উপস্থাপকের মিথ্যা দাবির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বলেন,ইউনূস দেশ ছেড়েছেন এবং এখন প্যারিসে রয়েছেন।
সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা: ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের পর ফার্স্টপোস্ট, দি ইকোনমিক টাইমস, রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড ও অপইন্ডিয়া সহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় গণমাধ্যম মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দাবি করেন, আলিফ হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী ছিলেন,যাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো আলিফকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে বলে মিথ্যা দাবি করেন। তবে, প্রতিবেদন অনুসারে আলিফকে যে প্রকৃতপক্ষে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীরা হত্যা করেছে এ বিষয়টি শ্পষ্ট হয়েছে।
বিশ্লেষণ:
বিশ্লেষক ফরিদ এরকিজিয়া বখত ও সিদ্ধার্থ বরদরাজনের মতে, ভারত শেখ হাসিনার মতো মূল্যবান মিত্র হারানোর হতাশা এবং ভারতীয় বিরোধী মনোভাব পোষণকারী দেশে নতুন সরকার সম্পর্কে শঙ্কার কারণেই এই বিভ্রান্তিমূলক তথ্য-প্রচার ও প্রসার অভিযান দ্বারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ-উর-রহমানের মতে, ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ হাসিনা-সরকারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান “তাদের ইসলামভীতি দৃষ্টিকোণ” থেকে দেখে,তবে এটি সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল।
বিবিসি নিউজ,ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স ২৪ ও কিছু তথ্য যাচাইকরণ ওয়েবসাইট এক্স ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গুজব চিহ্নিত করেন বিবিসি ভেরিফাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত অতিরঞ্জিত বা প্রকৃত ঘটনার সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কিছু ভুয়া তথ্য চিহ্নিত করেন।
রিউমর স্ক্যানারের তদন্ত অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৯টি ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া সংবাদ প্রচার করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ, লাইভ মিন্ট, রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে,এবিপি আনন্দ, আজ তক, এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, এনডিটিভি,ওয়ার্ল্ড ইস ওয়ান নিউজ ইত্যাদি।তবে এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে রিপাবলিক বাংলা, যা সর্বোচ্চ সংখ্যক ভুয়া সংবাদ প্রচার করেছেন।
গুমের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। পরোয়ানা জারির ঘটনায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এই অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং প্রমাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একই সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার ৭ জানুয়ারি-২০২৫ ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের সাথে আলাপকালে দেশটির সাবেক এই কূটনীতিক বলেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন এই বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পায়নি।
বিশ্বব্যাপী যে সমস্ত বিশ্ব মোড়লরা প্রতিটি মূহুর্তে গণমানুষের অধিকারের কথা বলে,স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্বের কথা বলে,সাম্যমৈত্রি,বিশ্বশান্তি ও ভ্রাতৃত্বের কথা বলে,তারায় আজ বিশ্ব শান্তি প্রিয় ও স্বাধীনতাকামী গণমানুষের অসাহায়ত্বকে পুঁজি করে বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং আগুন জ্বালাতে সহায়তা করছে।এবং মূলত তারায় বিশ্বব্যাপী বহুমাত্রিক অন্যায়-অনিয়ম কয়েম করে দুনিয়া শাসন করছে। ক্ষমতার মসনদে বসে, জবরদখল, ক্ষমতার অপব্যবহার,ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জনসাধারণের উপর বহুমাত্রিক জুলুম-নির্যাতনের রাজনৈতিক কালচার থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি দেশ,একে অপরের প্রতি বন্ধু সুলভ আচরনের মধ্যদিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রঠিষ্ঠার লক্ষ্যে, দলমত,জাতী-ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বব্যাপী সাম্যমৈত্রি ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে একে অপরের পরিপুরক হিসেবে কাজ করা এখন সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি।(মনে রাখা প্রয়োজন,অন্যায়ের ফল ভালো কিছু বয়ে আনে না,সম্প্রতী তার জলন্ত দুটি উদাহরণ,একটি শেখ হাসিনা ,অপরটি বাসার আল আসাদ)।
উল্লেখ্য: হাজারো অপরাধের পরেও হাসিনার পক্ষে ভারতের সাফায় সাক্ষী এবং ভারত এতো কিছু করার পরেও হাসিনার ভারত প্রীতি-আমার কাছে মনে হয় এ যেন আম আর দুধ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।