ভূ-রাজনীতির নতুন ক্ষেত্র ‘ব্রিকস’ : যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মাত্রা
ক্রমেই ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা- পাঁচ দেশের জোট) প্রসারিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ আগস্টে এতে যোগদানের আশা করছে। এর ফলে মনে করা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মুদ্রা ডলারের আধিপত্য মোকাবিলায় একটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। ভারতের দৈনিক ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের অনলাইন সংস্করণে রবিবার প্রকাশ হওয়া এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ব্রিকস- যা বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ প্রতিনিধিত্ব করে, পশ্চিমের জন্য একটি শক্তিশালী নতুন কণ্ঠস্বর বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পাঁচটি সদস্যদেশ বিশ্ব বাণিজ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ এবং বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ২৪ শতাংশ অবদান রাখে। ব্রিকসে শুধু বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, আলজেরিয়া, মিশর, কাতার, কুয়েত বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভেনিজুয়েলাসহ অন্যান্য দেশ যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্রিকসে যোগ দেয়ার মাধ্যমে মিত্রদেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর উল্টো চাপ বাড়াবে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নয়া মাত্রা পাবে। এতে ভূ-রাজনীতিতে নতুন দৃশ্যপট চলে আসবে এবং বাংলাদেশ তাতে সামনের সারিতেই থাকতে চায়।
রবিবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একটি স্বাধীন জাতি। আমরা যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ অর্জন করেছি। বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি অনুসরণ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার গুরুত্বপূর্ণদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কাজ করছে। দেশের উন্নয়নে যা যা প্রয়োজন তা করছে। অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ বারবার প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে; কিন্তু সফলতার সঙ্গে সেগুলো কাটিয়ে উঠেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখনো অনেক বাধা এবং ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। কারণ, একটি দেশ যখন দ্রুত অগ্রগতি করে, তখন অনেকেই তা সহ্য করতে পারে না। তারা বিভিন্ন ঝামেলা শুরু করে। একটি স্বাধীন ও বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দেশের সব মানুষকে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা নিয়ে চলার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এগুলো (বাধা-বিপত্তি) নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
এদিকে ভারতের দৈনিক ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি ব্রিকসে যোগ দেয়, তাহলে এটি সম্ভবত ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নতুন করে প্রভাব ফেলতে পারে। ব্রিকস হলো উদীয়মান অর্থনীতির একটি প্রভাবশালী ব্লক যেটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়নের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। বাংলাদেশ যদি ব্রিকসের সদস্য হয়, তাহলে তা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বাড়াতে পারে। এর ফলে উন্নত বাণিজ্য সম্পর্ক, বিনিয়োগের সুযোগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে, যা উভয় দেশকে উপকৃত করবে।
অন্যদিকে, ব্রিকসে যোগদান ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন গতিশীলতা ও বিবেচনার সূচনা করতে পারে। তবে ব্রিকসের সদস্য হিসেবে ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি সামঞ্জস্য করতে হবে। এটি অগ্রাধিকার, সহযোগিতার কাঠামো এবং ব্যস্ততার কৌশলগুলোর পুনর্মূল্যায়নের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্ত, বিশ্বব্যাপী জিডিপির একটি অংশ ধনী দেশগুলোর ক্লাব জি-৭কে ছাড়িয়ে গেছে, এটিকে বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রার বৈচিত্র্য আনার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে- বলেন গৌতম লাহিড়ী, একজন সিনিয়র সাংবাদিক এবং বাংলাদেশবিষয়ক ভাষ্যকার। তার মতে, যদিও তাৎক্ষণিক সুবিধাগুলো স্পষ্ট না-ও হতে পারে, তবে ব্রিকসে যোগদানের পর থেকে বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা দেবে; কারণ ব্লকটি মার্কিন এবং মার্কিন ডলারের আধিপত্য
কমাতে সক্রিয়ভাবে প্রসারিত হচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো সন্দেহ নেই, এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, উন্নয়নশীল অর্থনীতির বৃহত্তম ক্লাব হিসেবে ব্রিকসের মর্যাদা এবং এর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করে। ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ সাধারণ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, তখন ঢাকা ব্রিকসের সদস্য হওয়ার সুযোগ পেলে তা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি বাড়াবে বলে মনে করেন সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশকে তার বৈদেশিক সম্পর্কের বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করবে। ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে চীন এবং ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ দুই বাণিজ্য অংশীদার। আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশই এই দুটি দেশ থেকে করে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ২০২১ সালে ব্রিকস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সদস্য হয়েছে।
এর আগে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জেনেভায় বলেছেন, চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট মাতামেলা সিরিল রামাফোসার মধ্যে বৈঠক শেষে তিনি এ কথা বলেন। তার মতে, ব্রিকস ব্যাংক বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনেভায় ঘোষণা করেছেন, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবকেও ব্রিকসে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, এই দেশগুলো আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।