ভয়াবহ তারল্য সংকটে দেশের ডজনখানেক ব্যাংক। তাদের সংকট কাটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে ভালো ১০টি ব্যাংক। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরে সঙ্গে এক বৈঠকে এসব ব্যাংকের এমডিরা সম্মতি প্রকাশ করেন। একাধিক ব্যাংকের এমডির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, ইস্টার্ন, শাহজালাল ইসলামী, সিটি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ও পূবালী ব্যাংকও তারল্য সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি ব্যাংকের এমডি কালবেলাকে বলেন, যেসব ব্যাংককে সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, ওই ব্যাংকগুলোকে টাকা দিলে তা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবুও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলায় দিতে রাজি হয়েছি।
অন্য একজন এমডি বলেন, প্রত্যেক ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের ওপর এক্সিপোজার লিমিট আছে। এসব বিষয় ঠিক হয় ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের ওপর ভিত্তি করে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তো টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই; কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুরোধে দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি দিচ্ছে, আশা করি দেরিতে হলেও টাকা পাবো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, কিছু ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ৯টিতে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। তাদের সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫টি ব্যাংকের গ্যারান্টি দিতে চুক্তি করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে তহবিল পায়নি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ১০টি ব্যাংকের একটি সভা হয়। তারা আলোচনার মাধ্যমে সম্মতি দিয়েছে, যাদের প্রয়োজন তাদের সুবিধাটা দেবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো তিন মাসের জন্য আন্তঃব্যাংক থেকে গ্যারান্টি সুবিধা নিতে পারবে। যদি কারও সময় লাগে, তা বাড়িয়ে আরও ৯ মাস করতে পারবে। সুদের হার হবে স্পেশাল রেপো রেটে। আর ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কত টাকার গ্যারান্টি দেবে, তা বিবেচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে সংকটে থাকা সাতটি ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি তারল্য সহায়তা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি চেয়ে আবেদন করেছে। তবে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিতে চুক্তি সই করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ তারল্য সহায়তা নিতে পারবে, তাও ঠিক করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নগদ টাকার সংকট মেটাতে বিশেষ ধার চেয়ে আবেদন করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়ে আবেদন করে। এরপর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৫ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ৫ হাজার কোটি, এক্সিম ৪ হাজার কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ৩ হাজার ৫০০ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ২ হাজার কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংক দেড় হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তার গ্যারান্টি চেয়েছে।
জানা যায়, প্রাথমিকভাবে পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিপত্রে সই করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিপত্র সইয়ের পর গত রোববার সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, যেসব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তারা এখন আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্যারান্টির জন্য পাঠাবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টির আওতায় কোন ব্যাংক কত টাকা নিতে পারবে, তা বিবেচনা করে অনুমতি দেবে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়। এগুলোসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নামে-বেনামে ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে পাচারের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা। নামে-বেনামে টাকা বের করে নেওয়ায় তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে ব্যাংকগুলোয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। ঋণাত্মক হলেও লেনদেন অব্যাহত রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। টাকা ছাপিয়ে দেওয়া সেই বিশেষ সুবিধা এখন বন্ধ করে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
এ অবস্থায় সাময়িক সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর দুর্বল ব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোট নিয়ে রাখবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধার দেওয়া মানে সরাসরি টাকা ছাপানোর মতো। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে। এমনিতেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি টাকা না দিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। এর মানে বাজারের টাকা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি প্রভাব পড়বে না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির মানে হলো, কোনো কারণে এসব ব্যাংক ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই টাকা দেবে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের মাধ্যমে রুগণ ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা করবে বলে ইঙ্গিত দিলে পুনর্গঠিত এসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির জন্য আবেদন করে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেবে না। তবে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে এ সহায়তা নিতে পারে।’