রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ অপরাহ্ন

”তামাক জীবণের নয়”‌ তামাকের ভয়ংকর মহামারি-তামাক নিষিদ্ধ করি

এম.এ.জলিল রানা, জয়পুরহাট: / ১০৩ বার দেখা হয়েছে
আপডেট করা হয়েছে বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ৬:৩১ অপরাহ্ন

যে তামাক আমাদেরে লক্ষ লক্ষ অতি প্রিয় জীবণটাকে কেড়ে নিচ্ছে,পরিবার বিচ্ছন্ন করছে,যুবক,যুব সমাজসহ বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণী পেশার মানুষকে ধ্বংশ করছে,অগনিত জীবণকে তিলে তিরে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিচ্ছে,যে তামাকের কারনে সামাজিক মেল বন্ধনে ঘুণ ধরছে,রাষ্ট্র কাঠামেকে দূর্বল করছে,সে তামাকে কিসের এতো মায়া?এ তামাক কেন বন্ধ হচ্ছেনা?দূর্বলতা কোথায়? শুধুই রাজস্ব আয়ের বাহানা,নাকি সমস্যা অন্য জয়গায়।প্রশ্ন দেশ পরিচালনাকারীদের কাছে।

দেশব্যাপী ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য সেবনে দেশে মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিক রোগব্যাধির প্রকোপ দ্রুত মহামারির মতো ছড়াচ্ছে এবং এটা মহামারির আকার ধারণ করছে।চিকিৎসকরা বলছেন, তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই।৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে এই তামাকের ধোঁয়ায়।এর মধ্যে ৭০টিই ক্যানসার সৃষ্টিকারী।তামাক সেবনের কারনে করোনারি হার্ট ডিজিজ (হৃদরোগ) এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। মুখগহ্বর,ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়।অধূমপায়ীদের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুরঝুঁকি ১৩ গুণ বেশি।এছাড়াও মাথার চুল পড়া বা ঝরা, চোখে ছানি,পায়ে গ্যাংগ্রিন,পরিপাকতন্ত্রের রোগ,যৌনশক্তি হ্রাস(কমে যাওয়া)গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট হওয়া ও অকাল গর্ভপাতের কারণও এই তামাক সেবন।

একাধিক জরিপ বলছে,দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে থাকেন।আর ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানে(২০ দশমিক ৬ শতাংশ)এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ মানে(১৮ শতাংশ)।১৩- ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার (৯ দশমিক ২ শতাংশ)।প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয় এই তামাকজনিত রোগে।এছাড়াও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং,হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট)ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাগেই চলেছে অথচ এগুলো নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধে জোড়ালো-তো দূরের কথা সাধারণ কোনোও পদক্ষেপ গ্রহন করা হচ্ছে না বলে আমি মনে করি।  ।

বারডেম হাসপাতালের অনারারি সিনিয়র কনসালটেন্ট ও মাদকদ্রব্য নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) সভাপতি সূত্র বলেন,মানবদেহের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করে এই তামাক পণ্য।দেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬৫ হাজার মাসুষের মৃত্যুই নয়,সথে ১২ লাখ মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। আর এর মধ্যে পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছে ৪ লাখ শুধু মাত্র এই তামাক ব্যবহারের কারনে।এখন দেশে তামাকজনিত কারনে রোগের মহামারি চলছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন আছে,ব্যবহার নেই। ফলে অফিস আদালত, হাসপাতাল,পাবলিক প্লেস ও বিভিন্ন স্টেশন, মানুষ কোথাও কোনো স্থানেই নিরাপদ নয়।তামাক কোম্পানির কৌশলীদের রং রসের প্রচারণার কারনে প্রতিবছরই বাড়ছে তরুণ ধূমপায়ীর সংখ্যা।সূত্র আরও বলেন, ইদানীং ই-সিগারেটের প্রচলন শুরু হয়েছে।গবেষণা বলছে, ই-সিগারেটে ব্যাপক মাত্রায় বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে।এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের তথ্যমতে, বাংলাদেশে আচ্ছাদিত(মানে কিছুটা ঢাকা পরিবেশ) কর্মস্থলে কাজ করেন-এমন প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রায় (৮১ লাখ) পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ২৪ শতাংশ (২ কোটি ৫০ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গণপরিবহণে আসা যাওয়ার সময়,১৪ দশমিক ৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় এবং ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ চা-কফির স্টলে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।ভয়ংকর তথ্য হলো, প্রায় ৩৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানে প্রায়(৪ কোটি ৮ লাখ) বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।আর পরোক্ষ ধূমপানজনিত করনে প্রতিবছর প্রায় ৬১ হাজার শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হচ্ছে।

পরোক্ষভাবে ধূমপানের অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক।বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ:এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’শীর্ষক গবেষণার তথ্যমতে-২০১৭-১৮ অর্থবছরে পরোক্ষভাবে ধূমপানের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো)’র পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর মাসিক মোট খরচের ৫ শতাংশ তামাক ব্যবহারে এবং ১০ শতাংশ তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়।আর তামাকজনিত কারনে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বে বছরে আরও ৬৫২ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলার আয়ের-ক্ষতি হয়।

গবেষণা বলছে, কর্মক্ষেত্র, রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের পাবলিক প্লেসকে শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা গেলে কর্মীদের হৃদরোগে আক্রান্তের ঝুঁকি ৮৫ শতাংশ কমে যায়,শ্বাসতন্ত্র ভালো থাকে এবং ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে যায়। বর্তমানে নেপাল, তুরস্ক,থাইল্যান্ড,রাশিয়া,যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৭৪টি দেশ পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত আইন প্রণয়ন(ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার বিধান বাতিলসহ) ও বাস্তবায়ন করছে।২০১৯ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে। আর সিঙ্গাপুর,মালয়েশিয়া,থাইল্যান্ড শ্রীলংকাসহ ৩৪টি দেশে এসব পণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এমন স্বচ্ছ প্রেক্ষাপটে তারুণ্যনির্ভরশীল বাংলাদেশ এখন যেন তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট পয়েন্ট।তাইতো কোম্পানিগুলোর কৌশলী প্রচার-প্রচারণায় বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের ব্যবহার তরুণ এবং যুবসমাজের মধ্যে অতিদ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনলাইন ও ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা,বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে;যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগও উৎকণ্ঠার।

অ্যান্টি-টোবাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা)’র‌ সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা-২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার(এসডিজি) অর্জনে ১৬৯টি প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।যার মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) বাস্তবায়ন (টার্গেট-৩) ও অসংক্রামক রোগজনিত কারনে অকালমৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস(কম) (টার্গেট ৩.৪) অন্যতম।  এই সম্মিলিত উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ বাংলাদেশ।তাই আর দেড়ি নয় এফসিটিসি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা যায়, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছেন মন্ত্রণালয়।যেখানে পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহণে‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’রাখার বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট,ভ্যাপিং),হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ সব ধরনের পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাবও করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার ও কাঠামো শক্তিশালীকরণে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছেন।তমচিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত এ কমিটির বিশেষ সুত্র বলেন,পৃথিবীর অনেক দেশে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং দণ্ডণীয় অপরাধ।জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুততম সময়ে সংশোধন অথবা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

জনগণ আছে বলেই-তো দেশ আছে।আর তাইতো দেশ ও জাতীর কল্যাণে,দেশ জাতীর সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধী এবং নিরাপদ জীবণ ধারনের লক্ষ্যে দেশে রাষ্ট্র প্রধান,সরকার প্রধান,ইউপি সদস্য থেকে মন্ত্রী এবং জনগণের বহুমাত্রিক সেবার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়েজিত ঝাড়ুদার তেকে সচিব পর্যস্ত ব্যস্ত সময় পার করেন।পালাবদলে যে দল-ই ক্ষমতায় এসেছে,বহুমাত্রিক লুটপাটে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলেছে। অথচ দু,টাকার রাজস্ব আয়ের জন্য কেন প্রাণঘাতী তামাক ও বহুজাতীয় তামাক পণ্য দেশে লালন করতে হবে এর কোন অর্থই হয়না বলে আমি করি।তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করেই হোক অথবা নতুন আইন তৈরী করেই তামাক অবশ্যই নিসিদ্ধ করা প্রয়োজন এবং করতে হবে।সে ক্ষেত্রে তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন এবং বহুজাতীয় তামাক পণ্য আমদানী বন্ধ হলেই বাজারজাত অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে,চাই সদিচ্ছা।
(‌”তামাক জীবণের নয়”‌তামাক সমাজের নয়,তামক হলো প্রাণঘাতী….জীবণটা করে দেয় তিলে তিলে ক্ষয়”)

লেখক:এম.এ.জলিল রানা,সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট জয়পুরহাট৩০ অক্টোবর-২০২৪।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
Theme Created By Limon Kabir