নবী ও রাসুলদের সঙ্গে উম্মতের সম্পর্ক শুধু সংবাদ পৌঁছে দেওয়া বা পত্রবাহকের মতো নয়-পত্র পৌঁছে দেওয়ার পর আর কোনো সম্পর্ক থাকে না যার। এতটুকুতেই কোনো নবী তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করতেন না, বিশেষ করে নবীশ্রেষ্ঠ, শাফিউল মুযনিবিন, খাতামুন্নাবিয়্যিনের ক্ষেত্রে তো এ কথা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। উম্মতের প্রতি তাঁর দরদ, তাঁর প্রেম ছিল গভীর ভালোবাসার দ্যোতনায় ব্যঞ্জনাময়। উম্মতের প্রতি তাঁর দায়িত্ব সচেতনতা ছিল মাতা-পিতার চেয়েও স্নেহ ও সোহাগময়তায় সিক্ত, আর্দ্র।
আল্লাহ পাকের ভাষায় তাঁর সেই স্নেহময়তা ছিল-‘তোমাদের যা বিপন্ন করে তা ছিল তাঁর জন্য কষ্টকর। উম্মতের কল্যাণকামিতা ছিল তাঁর লোভের পর্যায়ের। তোমাদের বিষয়ে অতি আগ্রহী, লোভী।’ (সুরা : আত-তাওবা, আয়াত : ১২৮) উম্মতের প্রতি, মুমিনদের প্রতি তিনি তো ছিলেন অতি দয়ালু।
উম্মতের কারো ইহজাগতিক কষ্ট দেখলেও তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন। দুনিয়ায়ও ‘উম্মতি উম্মতি’ করেছেন, হাশরের ময়দানেও একই রব, একই আওয়াজ থাকবে পবিত্র জবানে। একটা সাধারণ উম্মতও জাহান্নামে থাকা পর্যন্ত তাঁর অস্থিরতা দূর হবে না। তাঁর সেই দরদ, ভালোবাসা ও স্নেহদ্রতার কথা কি পরিমাপ করা যায়!
একবার আল্লাহর দরবারে ব্যাকুল হয়ে ‘আল্লাহুম্মা উম্মতি উম্মতি’ বলে কাঁদছিলেন উম্মত দরদি (সা.)। মহান আল্লাহ জিবরাইল (আ.)-কে বলেন, যাও মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে, কিসে তাঁকে এত কাঁদাচ্ছে?
জিবরাইল (আ.) এলেন। নবী (সা.)-এর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলেন। তিনি উম্মতের চিন্তার কথা বললেন। আল্লাহপাক সব জানেন, তাঁর অজ্ঞাত কিছু নেই, তবু তিনি বলেন, জিবরাইল, যাও মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে। তাঁকে জ্ঞাত করো, আমি অবশ্যই আপনাকে আপনার উম্মতের বিষয়ে সন্তুষ্ট করে দেব। আপনার যেন তাদের নিয়ে কষ্ট না হয়।
(ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, হাদিস : ২০২)
তাঁর প্রতি উম্মতের সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর ভালোবাসা আর আনুগত্যের। এই উম্মতের প্রথম দল সাহাবিদের, আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রা.), আশারায়ে মুবাশশারা (রা.)।
বড়দের কথা না হয় না-ই বললাম, মদিনার একজন সাধারণ নারীর কথা স্মরণ করতে পারি, উহুদের ময়দানে যার পিতা, ভাই, স্বামী, সন্তান সবাই শহীদ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কথা শুনে নয়, নবী (সা.)-এর আহত হওয়ার খবর শুনে সেই নারী উতলা হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন উহুদের দিকে। লোকেরা যখন তাঁকে স্বামী, পুত্র, ভ্রাতা, পিতার শাহাদাতের সংবাদ দিচ্ছিল, তখন কোনো উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না করেই তিনি উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, বলো, নবীজি (সা.) কেমন আছেন? তিনি ভালো আছেন তো? দূরে যখন নবী (সা.)-কে দেখা গেল, অপেক্ষা না করে দৌড়ে গেলেন তিনি। নবীজি (সা.)-এর মুবারক চাদর দুই হাতে নিয়ে মুখে বুলালেন, বুকে লাগালেন। বললেন, ‘হে নবী (সা.), আমার পিতা-ভ্রাতা শহীদ হয়েছেন, স্বামী-সন্তান শহীদ হয়েছেন, আপনাকে যখন জীবিত দেখতে পাচ্ছি, কিছুরই আর পরোয়া নেই আমার।’ এই ভালোবাসার কি কোনো উপমা আছে? কোনো নজির আছে এই পৃথিবীতে?
আবু তালহা (রা.) দুশমনদের তীরের বৃষ্টির সামনে নিজের বুক পেতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-‘হে নবী (সা.), এই বুক আপনার ঢালস্বরূপ। আপনি এর পেছনে নিরাপদে থাকুন। দয়া করে মাথা ওঠাবেন না, দুশমনের কোনো তীর এসে লেগে যেতে পারে।’
আর জায়েদ ইবনুদ দাসিনা (রা.)-এর সেই বিখ্যাত উক্তি কি ভোলা যায় কখনো? তাঁকে যখন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হলো, শূলে চড়ানো হলো, কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ান তখন বলেছিল, ‘হে ইবনুদ দাসিনা, তুমি তোমার ঘরে নিরাপদ থাকবে, আর তোমার স্থলে এখানে তোমাদের মুহাম্মদকে এনে শূলে লটকানো হবে, এ কথা কি তুমি পছন্দ করবে?’
তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘কী বলছ? আল্লাহর কসম! রাসুলুল্লাহ (সা.) যেখানে আছেন সেখানেও তাঁর গায়ে একটা কাঁটা ফুটবে আর আমি আমার ঘরে বসে থাকব, তা-ও তো আমার পছন্দ নয়।’ এ অবস্থা দেখে সর্দার আবু সুফিয়ানের (তখনো তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি) মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে, মুহাম্মদের সাথিরা যেভাবে তাঁকে ভালোবাসে, আর কারো মধ্যে এমন ভালোবাসা আমি দেখিনি। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ৫ : ৫০৫) আর কার কার কথা বলব? প্রতিটি ফুলের গন্ধ ও রং তো এমনিই ছিল।
সাহাবায়ে কেরামসহ আজ অবধি মুমিনদের জীবনে আমরা এর ভূরি ভূরি উদাহরণ প্রত্যক্ষ করি। আর হবেই না বা কেন? আমরা জানি, এই পৃথিবীতে চার কারণে সাধারণত একজনের আরেকজনের প্রতি ভালোবাসা হয়ে থাকে-ক. জামাল : সৌন্দর্য, খ. কামাল : গুণাবলি, গ. নিওয়াল : অনুগহ, ঘ. কারাবাত : আত্মীয়তার নৈকট্য।
এগুলোর যেকোনো একটিতেই কারো প্রতি কারো অনুরাগ হয়, আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। আর নবী (সা.)-এর মধ্যে তো এর সব সমাহার ছিল পরিপূর্ণভাবে, নিখুঁতভাবে। তাঁর চেয়ে সুন্দর আর কাউকে পয়দা করেননি আল্লাহপাক। সব সৃষ্টির মধ্যে তাঁর চেয়েও কামাল ও গুণাবলির অধিকারী করেননি আর কাউকে। তাঁর চেয়ে অধিক কারো অনুগ্রহ ও ইহসান নেই এই দুনিয়াবাসীর ওপর, তিনি তো ছিলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। তাঁর চেয়ে একজন মুমিনের কাছে আত্মার আত্মীয়, তাঁর চেয়ে গহিন নিকটতর আর কে আছে? আর কে হতে পারে?
রাসুল (সা.)-এর ক্ষেত্রে মনের গহিন থেকে উদ্গত এই ভালোবাসা আদব ও শিষ্টাচার মণ্ডিত, কৃতজ্ঞতা আপ্লুত, প্রাণময় আবেগ অন্তরের গভীর কন্দর থেকে উদ্গত হয়ে ধমনিতে ধমনিতে ছেয়ে যায়, শিরা-উপশিরা সবকিছুকে প্লাবিত করে ফেলে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে, ‘বলে দিন, তোমরা যদি ভালোবাসো আল্লাহকে, তবে আনুগত্য ও অনুসরণ করো আমার। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন। আর ক্ষমা করে দেবেন তোমাদের পাপরাজি। আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)
শুধু অনুসরণেই নয়, এমনকি নিজের কামনা-বাসনা সবকিছু নবীজি (সা.)-এর অধীন করে নিতে হবে। হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মুমিন বলে বিবেচ্য হতে পারবে না, যতক্ষণ তার কামনা-বাসনা সবই আমি যে দ্বিন নিয়ে এসেছি, এর অধীন না হবে।’ (আত-তিরমিজি, মিশকাত : ১৬৭)
রাসুল (সা.) অনুসৃত রীতিনীতি, আচার-আচরণ ইসলামের মৌল প্রকৃতি ও ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। এর বিপরীত যত পথ, যত রীতি-পদ্ধতি সবকিছুই ফিতরাত ও শরিয়তের মেজাজ বহির্ভূত বলে গণ্য।