বায়ুহীন বাতাস মাতবেগে বায়,সবুজ ধরণীতে শ্রমিকরা ঝড়ায় ঘাম,সবায় বসে খায়। শ্রমিকের ধূলীকণা-ময়লা আর কাঁদামাটিতে মিশে থাকা শরীরের ঘাম ঝরানো উৎকর্সের বিনিময়ে মানবসভ্যতা প্রতিনিয়তই একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে।তাই আবারও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান মে মাসের এই বিদায় বেলায় বিশ্বের সম্মানিত সকল শ্রমিকদের।যারা বিশ্বব্যাপী উঁচু শ্রেণীর মানুষগুলোর জীবণ-জীবিকার প্রধান চালিকাশক্তি। আর এই সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে বিশ্বব্যাপী এই শ্রমিক শ্রেণী। শিল্প বিপ্লবের পর বিশ্বের নানান প্রান্তে শ্রমঘন এলাকা তৈরি হয়েছে, যেখানে একটি কারখানা বা শিল্পকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক একত্র হয়েছে। নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হয়েছে শ্রমিক শ্রেণি,বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রমিক ইউনিয়ন। শিল্প বিপ্লবের পর দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের কর্মঘণ্টার বিষয়টি সমাধান হয়নি, অঢেল পুঁজির অধিকারী মালিকপক্ষই ঠিক করে দিচ্ছে শ্রমিকের কয় ঘণ্টা কাজ করতে হবে।একজন শ্রমিকের কাছ থেকে দৈনিক ১০-১২ কিংবা তার চেয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ আদায় করিয়ে নেয়া হয়েছে । এই দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রভাব পড়েছে তার দৈনন্দিন জীবনে। আর তাই বিশ্বের নানান প্রান্তের শ্রমিক সংগঠনগুলো কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে।তাই মে মাসের ১ তারিখে যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে থাকে, মূলত সেটিও ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয়েছিল। তবে এই আন্দোলন বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির সামগ্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্বজুড়ে এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল ব্যাপক, বিশেষ করে ইউরোপের শ্রমঘন এলাকায় এ ঘটনাটি ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শিকাগোতে শিল্পায়নের বিকাশের সময় প্রচুর জার্মান,ব্যাভারিয়ান শ্রমিক সেখানে স্থায়ী হয় এবং এই শ্রমিক আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তারা। তাদের যুক্ত থাকার কারনে এ ঘটনা ইউরোপে বেশ আলোচিত প্রভাব ফেলে। ১৯১৭ সালের পর বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে সোভিয়েত রাশিয়ার বৈপ্লবিক উত্থানের পর সোভিয়েত ক্ষমতাগণ্ডিতে থাকা দেশগুলোতে মে মাসের ১ তারিখে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বেশ ঘটা করে উৎযাপন শুরু হয়। সোভিয়েত পতনের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক দেশেই আর মে দিবস পালন হয় না , তবে এখনও বিশ্বের অনেক দেশেই এ দিন সরকারি ছুটি হিসেবে চিহ্নিত।
বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ নেই, ২০১৯ সালে দেখা গেছে ফ্রান্সে ইয়োলো ভেস্ট আন্দোলন।শুধু এটিই নয়,বাংলাদেশ সহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিয়মিতই শ্রমিক অসন্তোষ এখন দৃশ্যমান।এটিও প্রমাণ করে যে পুঁজি টিকিয়ে রাখা এবং মুনাফার স্বার্থে কর্মজীবীদের ক্রমন্বয়ে শোষণ করেই চলেছে বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানগুলো,একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর সাথে বাকিদের বেতনের বৈষম্য নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠছে । তাইতো মে দিবস নামে বহুল পরিচিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বিশ্বের নিপীড়িত,শুষিত ও বঞ্চিত কর্মজীবী মানুষকে এখনও পথ দেখায় নিজেদের অধিকার আদায়ে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’ শ্রমিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর রক্তঝরা উৎকর্সের অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে পহেলা মে তারিখকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয় । এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে । ঐতিহাসিক ও মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় এবং বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের একটি দিনও বটে।মনে রাখতে হবে, দেশ- জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধীর লক্ষে শ্রমিকদের উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান অতি আবশ্যক।সব শ্রমজীবী মানুষকে এক অর্থে শ্রমিক বলা যেতে পারে।
শুধুমাত্র পরিবহন, পোশাক কিংবা কলকারখানায় কাজ করা, নিচের বা ছোট পদের মানুষকে শ্রমিক হিসেবে গণ্য না করে বরং কায়িক পরিশ্রম করা মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। হতে পারে তিনি দিনমজুর কিংবা চাকরিজীবী অথবা ব্যবসায়ী। মূলত সবাই শ্রম দিচ্ছেন যার যার স্তরের শ্রমিক হিসেবে।পহেলা মে সারা বিশ্বে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামী স্মারক হিসেবে মে দিবস পালিত হয়। এ দিবসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে।১৯ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের নিশ্চয়তা ছিল না কোনো ন্যায্য মজুরির , আর ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়ের সীমা। মালিকরা খেয়ালখুশি মতো শ্রমিকদের দিয়ে দৈনিক ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতেন।
১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষে শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে ধর্মঘট পালন করেছিল। আর এ ন্যায্য আন্দোলন দমিয়ে রাখতে আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ৩শ শ্রমিক আহত হয়েছেন। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনেক শ্রমজীবী মানুষ নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। সে দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্প-কারখানা সহ সব শিল্পাঞ্চলে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন শ্রমিকরা।লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভের মুখে শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেট রূপ নেয় শ্রমিক সমুদ্রে।শহরের প্রয় ৩ লক্ষাধিক মেহনতি মানুষ কাজ বন্ধ রেখে সংগ্রামের লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে নেমে আসেন রাস্তায়। এ সময় আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর কোন উসকানি ছাড়ায় নির্বিচারে গুলি চালায় সরকারের পুলিশ বাহিনী।ওই দিনই ১০ জন শ্রমিক নিহত হন ,আর আহত হন হাজার হাজার শ্রমিক। তবুও চলমান থাকে ধর্মঘট ও আন্দোলন।
এরপর ৩ মে রিপার কারখানার সামনে প্রতিবাদ সভায় পুলিশের গুলিতে আবারও প্রাণ হারান আরও ৬জন শ্রমিক। এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৪ মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ কালের বিশাল শ্রমিক সমাবেশ। সমাবেশে আবারও পুলিশ বাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালায় । ওই ঘটনায় নিহত হয় ৪ শ্রমিক ও ৭ পুলিশ ।
আন্দোলনে অংশ নেয়ার কথিত অপরাধে বহু শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয় । গ্রেপ্তারকৃত ৬ শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আর কারাগারে আত্মহত্যা করেন ১ শ্রমিক।হাজার হাজার শ্রমিককে কারাগারে আটকে রেখে নির্মম-নির্যাতন করা হয়। দাবি আদায়ের জন্য সেদিন শ্রমিকদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়েছিল রাজপথ। হে মার্কেটে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ, রক্তস্নাত প্রতিরোধযুদ্ধ,এবং আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় হয় শ্রমিকদের।
দীর্ঘদিনের শোষণ আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এ দিনে শ্রমিকরা রক্ত ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এক অপার উপাখ্যান বা গল্প ।সরকার অবশেষে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর শিল্পায়নের অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠে শিকাগো শহর।আমেরিকান শ্রমিকের পাশা-পাশি তখন শিকাগো শহরে জার্মানি এবং ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকরা কাজের খোঁজে আসতে শুরু করে। গড়ে প্রতিদিন দেড় ডলার মজুরিতে হাড়ভাঙা খাটুনি,কাজ করতে হয় সপ্তাহে ৬ দিন তাও আবার মালিকপক্ষের ইচ্ছে অনুযায়ী ও সময়মতো। দীর্ঘদিন কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদেরও একটি যন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে , উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা কিংবা কোনো দাবি তোলা ছিল তার ক্ষমতার বাইরে। ৮ ঘণ্টাকে প্রমাণ কর্মঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মালিকদের হাতে নিপীড়িত হয়েছেন অনেক শ্রমিক,যাদের বেশিরভাগই সংগঠিত ছিল না। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চাইলেই নিপীড়ন আর নির্যাতন করে নজির সৃষ্টি করা শ্রমিকদের মনে প্রচণ্ড ভয়ের সঞ্চার করা হয়েছে।
এভাবে এক পর্যায় পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন আমেরিকার শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, উইসকনসিন এবং বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে উঠতে থাকে সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন। ১৮৮৪ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকার ফেডারেশন অফ অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়নস-এর এক বৈঠকে ৮ ঘণ্টা কাজের সময়কে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় সে বিষয়ে শুরু হয় আলোচনা। আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিক্রমে-১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখকে ঠিক করা হয়,যে দিন ডাকা হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘট। একটাই দাবি , ৮ ঘণ্টার বেশি আর কাজ নয়। মালিকপক্ষ এ আন্দোলনকে মোকাবেলা বা প্রতিহত করার জন্য শুরু থেকেই শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের করতে থাকে গ্রেপ্তার ,আর আন্দোলনকারীদের বাছাই করে চালাতে থাকেন নিপীড়ন ও নির্যাতন ।
এতে করে শ্রমিক অসন্তোষ কমে না বরং ক্রমান্বয়ে আরও বাড়তেই থাকে। মালিকপক্ষের চাপিয়ে দেয়া ১৪ ঘণ্টা বা ১৬ ঘণ্টা কাজের শিকল ভেঙে আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণি দাবি তোলেন দৈনিক ৮ ঘণ্টাকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসবের দিন,জাগরণ আর উল্লাসের দিন, শোষণ-বঞ্চনা ও শোষণমুক্তির অঙ্গীকার এগুলোই হচ্ছে মূলত মে দিবসের তাৎপর্য।শ্রমিকদের জীবন দানের বিনিময় বিশ্বজুড়ে সেই দাবি আজ দৃশ্যমান ও স্বীকৃত। আমাদের দেশেও পালন করা হয় এ দিনটি।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেন। একই সাথে আইএলওর ৬টি কোর কনভেনশন সহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের অধিকার রক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক।
১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত,একদিকে শোষক আর অন্যদিকে শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশা-পাশি অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে দলমত জাতী ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একাতাবদ্ধ হতে হবে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জণে শ্রমিক-মালিক সমপ্রীতি দেশের উন্নয়নের গতি ধারাকে ত্বরান্বিত করবে।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশ শুধু নয়,বিশ্বব্যাপী শ্রমিকরা আজ অবহেলিত।তাদের নেই কোনো অধিকার,নেই কোন ভবিষ্যৎ। নেই যথার্থ মূল্যায়ন। শ্রমিকরা আদৌ কি ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে? প্রতিনিয়তই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে । আর তারা যদি ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে,তাহলে পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। অথচ তারাই এ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাদের মূল্যায়ন করা খুবি জরুরি। কারণ তাদের ওপর নির্ভর করে আজও আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির চাকা সচল। বস্তুত বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সামগ্রিক উন্নতির মূলে সৃজনশীল গরিব শ্রমিক। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া যেমন কাম্য নয়, তেমনি সবায়কে শ্রমিকবান্ধব হওয়াও বাঞ্ছনীয়।পরিবহন শ্রমিক,পোশাক শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প কল-কারখানার শ্রমিক সহ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সব শ্রমিকের সামগ্রিক স্বার্থ ও সঠিক মর্যাদা রক্ষার্থে মালিক পক্ষকে সব অবহেলর ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায্য মজুরি প্রদান সহ শ্রমিকসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। তবেই হবে মহান ও ঐতিহাসিক মে দিবস-এর অঙ্গীকার পূরণ এবং এ দিবস হবে সার্থক।
শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে:দুই দশকে
(UNICEF)। Jun 11, 2021-কোভিড-১৯ এর প্রভাবের কারণে আরও লাখ লাখ শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে।
১১ ডিসেম্বর ২০২৩ এর এক তথ্যেমতে বর্তমানে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে ১ কোটি ৪৯ লাখের বেশি কর্মী কর্মরত আছেন বলে জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আইএলওর প্রতিবেদন:২৩ এপ্রিল ২০২৪। অতিরিক্ত তাপে বিশ্বে বছরে ১৯ হাজার শ্রমজীবীর মৃত্যু।
অতিরিক্ত তাপের ঝুঁকির ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা অতিরিক্ত তাপের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৮ হাজার ৯৭০ জন শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এনশিউরিং সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাট ওয়ার্ক ইন আ চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ (জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা) শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। ৩৪০ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে ২৪০ কোটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন। অর্থাৎ, বৈশ্বিক শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন।
২০২০ সালের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।প্রতিবেদন বলা হয়,২০০০ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি কর্মী অতিরিক্ত তাপের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন। তাপমাত্রা ও শ্রমশক্তি বাড়ার কারণে এ সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আইএলওর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (ওএসএইচ) দলের প্রধান মানাল আজি বলেন, এটা এখন স্পষ্ট যে জলবায়ু পরিবর্তন কর্মীদের উল্লেখযোগ্য হারে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।এই ঝুঁকিগুলোর বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় নীতি গ্রহণ ও কার্যকলাপবিষয়ক যা যা করা হয়, তার মধ্যে অবশ্যই পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আইএলও প্রতিবেদনে আরও যা আছে
আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত গরমজনিত প্রায় সোয়া দুই কোটি ‘পেশাগত দুর্ঘটনায়’ ২০ লাখের বেশি মানুষকে নানা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। কৃষি, নির্মাণ,পরিবহন খাতের মতো বাইরে কাজ করা কর্মীরা অতিরিক্ত গরমের কারণে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে পড়ছেন। তাঁরা হিটস্ট্রেস, হিটস্ট্রোক, হিটক্র্যাম্পস, র্যাশ, ত্বকে ক্যানসার, হৃদ্রোগ, শ্বাসজনিত অসুস্থতা, কিডনির রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নানা জটিলতায় পড়ছেন।
প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের আরও নানা কারণে কর্মক্ষেত্রসংক্রান্ত মৃত্যুর তথ্য উল্লেখ করা হয়।এতে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ১৬০ কোটি মানুষ আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশনের ঝুঁকিতে পড়ে। এ কারণে ত্বক ক্যানসারে বছরে মৃত্যু হয় ১৮ হাজার ৯৬০ জনের। বাইরে বা রাস্তাঘাটে কাজ করা ১৬০ কোটি মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হয়।এর ফলে ৮ লাখ ৬০ হাজার কর্মীর মৃত্যু হয়। ৮৭ কোটির বেশি মানুষ কৃষিকাজ করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা বিভিন্ন কীটনাশকের সংস্পর্শে আসেন।বছরে ৩ লাখের বেশি কর্মী কীটনাশকের বিষাক্ততার কারণে মারা যান।পরজীবী, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসবাহিত রোগের সংস্পর্শে এসে (ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ সৃষ্টিকারী) বছরে ১৫ হাজার কর্মী মারা যান। চরম আবহাওয়ায় ভূমির পরিবর্তন,খাদ্যসংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাবের মধ্যে কাজের নিশ্চয়তা কমে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে হতাশা শুরু হয়।
মনে রখতে হবে বিশ্বায়নের যুগে আধুনিকতার আদলে বিশ্বব্যাপী ক্ষেত মজুর থেকে কৃষি খামার,মৎস চাষাবাদ থেকে নদী সমুদ্রে মৎস আহরণ,ছোট্ট টেইলারিং দোকান ও হস্তশিল্প থেকে গের্মেন্ট,ছোট্ট ছোট্ট শিল্প-কল কারখানা থেকে বহুমাত্রিক ভারি ভারি বৃহৎ শিল্প খারখানা,ইট তৈরী থেকে অট্টালিকা নির্মাণ,ঐতিহাসিক স্থাপত্য শৈলীর চোখ জুড়ানো কারুকাজ থেকে এ সময়ের অত্যাধুনিক নান্দনিক ছোঁয়ার শৈপ্লবিক কারুকাজ মণ্ডিত বহুমাত্রিক স্থপত্যে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে বিশ্বে এই অবহেলিত শ্রমিকরায়।তাই আমি মনে করি,বিশ্বব্যাপী যে কোন বিষয়ে যদি কোন উদাহণ সৃষ্টি হয়ে থাকে তা শ্রমিকদের জন্যই হয়েছে।বিশ্বব্যাপী নানান ক্ষেত্রে বহুমাত্রি সফলাতার স্বর্ণাউজ্জল স্বাক্ষর রেখেছে আজকের এই শ্রমিক।বর্তমান বিশ্বে যদি শেলিব্রেটি বা নজির সৃষ্টিকারী কোন ব্যক্তিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় তবে সেখানেও মনে হয় শ্রমিকরায় অগ্রগামী।তাই শ্রমিককে বাদ দিয়ে বিশ্বয়নের যুগে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলা আদৌ সম্ভম নয়।কারণ পৃথিবীর এমন কোন যায়গা নেই,যেখানে শ্রমজীবীদের পদচারণার নেই।
তাই বলি,সুখী সমৃদ্ধশালী বিশ্ব গড়তে শ্রমিককে কর মূল্যায়ন,তবেই হবে বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী উন্নয়ন। শ্রমিক ছাড়া বিশ্বায়নে সবায় যেন নি:শ্ব,শ্রমিকরায় কেবল গড়তে পারে,সুখী সমৃদ্ধশালী নান্দনিক এক বিশ্ব।ফলে আমার দৃষ্টি কোণ থেকে মনে হয় বিশ্বে শ্রমিকরায় উন্নয়নের প্রথম সারির আইকন হওয়ার যোগ্য।বহুমাত্রিক প্রতিপাদ্যে মে দিবস আসে-মে দিবস যায়।দিবসের প্রতিপাদ্য দিবসেই সীমাবদ্ধ শ্রমিকদের ভাগ্য নাহি বদলায়।
লেখক: সাংবাদিক