অর্থনৈতিক উদারনীতি বা মুক্ত বাজার অর্থনীতির চিন্তা মূলত ব্যক্তি স্বাধীনতার মনন,মানসিকতা ও চেতনাবোধ থেকেই আসে। আর এ বোধশক্তি থেকেই দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব হয়েছে । ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারি হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনা হয়েছে। মূল্যের সমতা ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য নির্ভর করা হচ্ছে খোলাবাজার ব্যবস্থাপনার ওপর। মনে করা হচ্ছে,এতে উত্পাদক ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হবে।জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করবে মুক্তবাজার ব্যবস্থা। প্রকৃত পক্ষে সব সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।মুক্তবাজার অনেক সময়ই সফলভাবে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করে না।আর তাছাড়া মুক্তবাজারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গরিব আর অতিনিম্ন আয়ের স্বার্থ রক্ষা হয় না।
সংকটকালীন মুনাফা অর্জন থেকে লোভী ব্যবসায়ীদের থামানো যায় না। এ জন্যই দরকার হয় হস্তক্ষেপ। প্রয়োজন পড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু কিছু মানুষ এমন আছেন, যারা এ সত্যটিকে মেনে নিতে চান না। বাজার কুশীলবরা সব সময়ই যুক্তিযুক্ত আচরণ করবেন বলে তারা ধারণা পোষণ করেন।ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা প্রায়ই সরকারকে নিষ্ক্রিয় বা নিরব থাকার পরামর্শ দেন।আর এ সুযোগে অতি মুনাফা অর্জনকারী মজুতদার ও ব্যবসায়ীরা বাজারকে অস্থির করে তুলেন।তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশেষ করে অতি সাধারণ ভোক্তারা। এ সময় সরকার শুধু রেফারির মতো আচরণ করবে আর বাজার-কুশীলবরা তাদের ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ে খেলবেন, যেটা যুক্তি দিয়ে টেকানো কঠিন।
নিত্যপণ্যের বাজারে লাগাম টানতে প্রতিদিন সরকার পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং,বাজার মুনিটরিং এবং মোবাইল কের্টি পরিচালনা হচ্ছে।গণমাধমে শত শত সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে ।এ সব কিছু মিলে সরকার-গণমাধ্যম সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই যেন বাজার নিয়ন্ত্রনে আদা জ্বল খেয়ে লেগে পড়েছে, কিন্তু সুফল কোথায়?
বাজার মুনিটরিং-এ কর্মকর্তারা সাধরণত চাষী ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের মাঝে খুচরা ব্যবসায়ীদের বেচাকেনায় দামের তফাতটাই দেখছেন যে,কি দামে কিনে কত দামে বিক্রি হচ্ছে।এটা কোন সমাধান নয়।আবার এই মুনিটরিং এর সূত্র ধরে পাইকারী-খুচরার মাঝে বেশী ব্যবধান হলে,সে ক্ষেত্রে মোবাইল কের্টি পরিচালনা করে জরিমানা আদায় কারা হচ্ছে।চলমান পরিস্থিতিতে এটাও যতেষ্ট নয়।
ফিরে দেখি দেশের জনপ্রিয় ইস্যু,নিত্যপ্রয়োজনীয় সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে প্রসংঙ্গিক তথ্যগত আলাদা কয়েকটি পরিসংখ্যান।২০২৪ সালের ১৪ মে, প্রকাশিত এক তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট গ্রামের সংখ্যা ৮৭ হাজার ৩১৯,মোট মৌজা ৫৯ হাজার ৯৯০,ইউনিয়ন সংখ্যা ৪,৪৮৪, এবং ২০২৪সালের ২৯ মে প্রকাশিত তথ্যে,বাংলাদেশের মোট থানার সংখ্যা রয়েছে ৬৫২ টি।আর প্রতিটি গ্রামে গড়ে বসবাস করে ২৩২টি পরিবার।৬৪ জেলা,৮ বিভাগ এর সমন্বেয়ে
মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও (প্রায় ১৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার) কম এই ক্ষুদ্রায়তনের দেশটির জনশুমারি ও গৃহগণনার ২০২২-এর ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ০১ জানুয়ারি প্রাক্কলিত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। যেখানে নারী ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯০ হাজার এবং পুরুষ ৮ কোটি ৪২ লাখ জন।সে হিসেবে দেশে এখন প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ৩০৬৪ জনেরও বেশী।বিশ্বে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অষ্টম জনবহুল দেশ,আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি লাল সবুজের এই বাংলাদেশ।
জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর ‘ন্যাশনাল রিপোর্ট’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ৫০ লাখ ৫৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বসবাস করছেন। প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যমতে,বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে গ্রামে বসবাস করেন ১১ কোটি ৬০ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৪ জন। শহরে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ৬৩ হাজার ১০৭ জন। সিটি কর্পোরেশন গুলোর মধ্যে ঢাকার দুই সিটিতে বাস করেন ১ কোটি ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৬ জন।
দেশে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪৬টি।২০২১-২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, দেশে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় নিয়োজিত স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭। এর মধ্যে পাইকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৪টি এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় কর্মসংস্থান প্রায়-৯২ লাখ।
এছাড়াও জাতিসংঘের ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বা জাতিসংঘ পুঁজি উন্নয়ন তহবিল কর্তৃক-২০১৮ সালে পরিচালিত জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী,বাংলাদেশে ১৩.১০ লাখ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছে,যাদের বছরে টার্নওভার হচ্ছে প্রায় ১৮.৪২ বিলিয়ন টাকা এবং প্রায় ২০ লাখ লোক এ ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে।
জাতিসংঘে তথ্যমতে বাংলাদেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায়-৪ কোটি ১৭ লাখ।তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, দেশে অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে। ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে অতিদারিদ্র্যের হার-৫.৬ শতাংশ।সে হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায়-৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার।
নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে জেনে নেই প্রতিদিন প্রকাশিত সংবাদের ধরণ এবং বাজার কুশীলবদের কমন ডায়ালগ।পেঁয়াজের উচ্চমূল্য,আলুর দামবৃদ্ধি,চালের বাজারে অস্থিরতা,সবজিতে কিছুটা স্বস্তি,ডিমের হালি চরা সহ অন্যান্য দ্রব্যমূল্য লাগামহিন ইত্যাদী।ব্যবসায়ীদের অজুহাত,করার কিছু নাই কারণ উত্পাদন কম,তাই পণ্য আমদানীতে সংকট।মূলত এ উচ্চমূল্য বাজার কুশীলবদেরই কারসাজি।
এবার যাই মূল কথায়। উল্লেখিত পরিসংখ্যানগুলোর তথ্য উপাথ্যে কি কি বিষয় দৃশ্যমান হয়েছে তা কমবেশী সবারই জানার কথা ? দেয়া হলো ,পরিবার, গ্রাম, মৌজা,ইউপি,থানা,জেলা এবং বিভাগের পরিসংখ্যান,সেই সাথে জনশুমারি ও গৃহগণনা,অতিদরিদ্র,ব্যবস্যয়ী এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবলেরও পরিসংখ্যান। ছোট-বড় ও মাঝারী এবং সকল শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের একটি বিষয় মাথায় রাখা খুবী জরুরী,পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্থানগত শ্রেণী বিন্যাসে এই জনসংখ্যা যেখানেই বসবাস করুক না কেন?আমরা সবায় এক ভূখণ্ডের বাসীন্দা,এক দেশের নাগরিক,আমরা সবায় একে অপরের পরিপুরক, আর মূলত এই আপামোর জনসাধরণ-ই আপনাদের (ব্যবসায়ীদের)মূলধন?জনগণ আছে বলেই ব্যবসা করে মুনাফা আয় করছেন,যাদের ওপর ভর করে আলিশান বাসায় বসবাস, দামী গাড়ী হাকিয়ে দাপিয়ে ছুটে চলা,অথচ আপনারা প্রতিনিয়তই এই মানুষগুলোরই পকেট কাটছেন।এখন গায়ের মাংস কাটতে কাটতে হড়ে ঠেকিয়েছেন।এখনো সময় আছে? অন্তত পক্ষে একেবারে অসহায় হতদরিদ্র মানুষের কথা ভেবে আপনারা মুনাফা অর্জণে সহণশীল হন,তাহলেই নিত্য পণ্যের বাজারে ফিরে আসবে সহনীয়তা।নিত্য পণ্যের উর্ধবগতির চাপে দিশেহারা মানুষগুলোর মাঝে আবার স্বস্তি ফিরে আসবে,গড়ে উঠবে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে সোহার্দ-সম্প্রিতীর বন্ধন,এমনটায় প্রত্যাশা লেখকের।
উল্লেখ্য,৫ আগষ্ট-২০২৪ এর ভয়াবহ পরিনতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।অন্যায়,অনিয়ম খুব বেশী সময় স্থায়ী হয় না।জুলুম ও অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে কি হয় ? জনগণ ফুঁসে উঠলে বিপদ সংকেত,ঝাঁপিয়ে পড়লেই মহাবিপদ,কোন বাধাঁয় আর কাজে আসবেনা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদি ও কলামিষ্ট জয়পুরহাট।