বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ০১:১৭ পূর্বাহ্ন

জয়পুরহাটে বাদাম তেল উৎপাদনে সফল এক নারী উদ্যোক্তা

জলিল রানা, জয়পুরহাট প্রতিনিধি : / ৮ বার দেখা হয়েছে
আপডেট করা হয়েছে মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫, ৩:৫৯ অপরাহ্ন

২৬ আগষ্ট-২০২৫। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের অবদান অপরিহার্য এবং বহুমুখী। তারা কৃষি, পশুপালন, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং গৃহস্থালি কাজসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। যদিও এই অবদান প্রায়শই স্বীকৃতি পায় না, তবুও গ্রামীণ নারীরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেন।এমনি এক সফল নারী উদ্যোক্তা জয়পুরহাটে বাদাম তেল উৎপাদনকারী বিথী পারভিন।
জেলার উদ্যোক্তা বিথীর ঘানিভাঙা বাদাম তেল নিয়ে যা বলেছেন তিন কর্মকর্তা । অনেক অনেক দিন আগের কথা,সে সময় গরু ও ঘোড়া দিয়ে কাঠের তৈরী ঘানিতে ভাঙানো হতো সরিষা।ঘানি ভাঙানো সরিষার এই তেল দিয়েই মেটানো হতো সংসারে যাবতীয় রান্নায় প্রয়োজনীয় তেলের চাহিদা। কালের বিবর্তন আর সময়ের ব্যবধানে এই ঘানি এখন প্রায় বিলুপ্তীর পথে। ফলে শতভাগ খাঁটি তেল পাওয়াটা এখন দুষ্করব্যাপার। এরকম এক পরিস্থিতিতে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে কাঠের ঘানি তৈরী করেও যে তেল উৎপাদন করা যায়, জয়পুরহাটের নারী উদ্যোক্তা বিথী পারভীন তার জ্বলজান্ত উদাহরণ।

জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ রাঘবপুর গ্রামের ওয়ালীউল হাসান রিপনের স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তানের জননী এই বিথী পারভিন। ২০১৯ সালে জয়পুরহাট সরকারী কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর-বিথী গৃহিণী হিসেবে বাড়িতেই থাকতেন তিনি। তবে কিছু একটা করা দরকার এই চিন্তায় স্থির থাকতে পারেননি তিনি। তার মাথাতে ঘুরপাক খেতে থাকে কিছু একটা করতে হবে, কিন্তু কি করা যায় ? হঠাৎ করেই একদিন তার মাথায় আসে কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল তৈরীর কথা। কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল করা যায় কিনা,? তা নিয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখি। পরে কাঠের ঘানি প্রস্তুত করে বিষয়টি নিয়ে স্বামীর সথে আলোচনা করে-২০২০ সালের আগস্ট মাসে শুরু করেন কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল উৎপাদন।তিনি গরুর পরিবর্তে এঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন প্রতিস্থাপন করেন। এক কেজি বাদাম বা সরিষা থেকে তেল উৎপাদিত হচ্ছে ২৫০ গ্রাম। এখন প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি বাদাম ভাঙানো হয়। বিথি এ প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘জয়পুরী অর্গানিকফুড’। ইতোমধ্যেই ভালো সাড়াফেলেছ এই তেল।তাই এখানে শুধু বাদাম তেল-ই নয়, সরিষা, কালোজিরাসহ সূর্যমুখী তেল ও উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তার।

তিনি বলেন, বাদাম তেলের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। অনেকেই রান্না, ত্বকের পরিচর্যা, চুলে দেয়া, বাচ্চাদের বিভিন্ন খাবার তৈরীর জন্য এই তেল কিনছেন।এতেলে স্বাস্থ্যভালো থাকে।বর্তমান প্রতি লিটার বাদাম তেল ৮৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আমরা একদম নির্ভেজাল তেল গ্রাহকদের নিকট সরবরাহের জন্য চেষ্টা করছি।

হাসিবুল হাসান:
জয়পুরহাট শহর থেকে বাদাম তেল কিনতে আসা হাসিবুল হাসান বলেন, আমি জেনেছি বাদাম তেল স্বাস্থ্যের জন্য নাকি  খুবই ভালো।কিন্তু আমি এই তেল খুঁজে পাইনি কোথাও।পরে শুনলাম নারী উদ্যোক্তা বিথী এনিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন।পরে যোগাযোগ করে এ তেল সংগ্রহ করি।

নুরুজ্জামান বাবু:
জেলার  পৌর শহরের খঞ্জনপুর এলাকার নিয়মিত বাদাম তেল ক্রেতা নুরুজ্জামান বাবু বলেন, আমরা কাঠের ঘানিতে ভাঙা কোল্ডপ্রেস বাদাম তেল পাচ্ছি।লোক মুখে শুনেছি এ তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।ব্লাডপেসার ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এ তেল খুব উপকারী। তাই আমরাও এটা ব্যবহার করছি এবং প্রতিবেশী-স্বজনদেরও ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করছি।আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি এখন আর ঘানি ভাঙা তেল পাওয়া যাচ্ছেনা।এজন্যই এর দাম একটু বেশি হলেও আমরা কিনছি।<br><br>

লিটন চন্দ্র ঘোষ:
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ: বলেন, কাঠের ঘানিতে তেল ভাঙা প্রথমত এটি একটি হারানো ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনেছেন বিথী পারভিন।তিনি কাঠের ঘানিতে বাদাম থেকে তেল উৎপাদন করছেন। বাদাম তেলে সরিষা ও সয়াবিনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আর এছাড়াও এ তেলে রয়েছে প্রোটিন, যেটা আমাদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যদি পণ্য বিপণনে এই উদ্যোক্তার কোনো সহযোগিতা লাগে, সে ক্ষেত্রে আমরা মেলাসহ অনলাইন গ্রুপ, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেব। এবং সেই সথে ‘বিএসটিআই’র নিবন্ধন করার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আর্থিক কোনো সহযোগিতাসহ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও আমরা তাকে সে সহযোগিতাটাও করবো।

জাহানারা আক্তার সুমি:
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার সুমি বলেন, বাদাম হলো প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদান। এটি শরীরের জন্য খুবই উপকারী।এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। যেমন বাদামে যে প্রোটিন রয়েছে তা অন্যান্য খাদ্য উপাদান থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং উন্নতমানের। ১০০ গ্রাম মিক্সড বাদাম থেকে প্রায় ২০গ্রাম প্রোটিন আমরা পেতেপারি। বাদামের তেলে যেহেতু বাদাম ব্যবহার করা হয় তাই বাদাম তেলে এসব পুষ্টিগুণ পাওয়া যাবে।বাদাম তেলে যে প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের শরীরের মাংসপেশীর গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। বাদাম তেলে যে ফ্যাট রয়েছে তা উপকারী ফ্যাট। সাধারণত খাদ্য থেকে আমরা যে ফ্যাট পাই তা দুই ধরনের। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। লাল মাংস বা অন্যান্য তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে কিন্তু বাদামে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন মুফা (মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) এবং ফুফা (পপি মনো স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) বেশি থাকে। যা আমাদের রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং শরীরের জন্য উপকারী এইচডিএল অর্থাৎ ভালো  কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। যা করোনা রিহার্ট ডিজিজ, ব্লাডপ্রেসার কন্ট্রোলে সাহায্য করে থাকে। বাদাম তেলে বিভিন্ন রকম ভিটামিন এবং খনিজ লবণ রয়েছে যেমন ভিটামিন ‘ই’ ভিটামিন ‘বি’ ইত্যাদি।এই ভিটামিনগুলো আমাদের ত্বক, চুল এবং আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোর সুস্থতার জন্য প্রয়োজন।<br><br>

পুষ্টি বিজ্ঞানী ড. এন এইচ এম রুবেল মজুমদার :
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্যবিজ্ঞান ও পুষ্টিবিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. এন এইচ এম রুবেল মজুমদার বলেন, সয়াবিন তেলের বিকল্পহতে পারে বাদাম তেল। তবে দাম বেশ চড়া। বাদাম তেলের রয়েছে বেশ গুণাগুণ।আমাদের দেশে সরিষা বা সয়াবিনের পরই দেখা যাচ্ছে গৃহস্থালিভাবে এ বাদাম তেল উৎপাদন করা হয়। এর উৎপাদনে বিভিন্ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। তার মধ্যে প্রাচীনতম একটি পদ্ধতি হলো ঘানি। এই  প্রক্রিয়ায় বাদাম তেল ভাঙলে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রা ৬০ডিগ্রির ওপরে না ওঠে অর্থাৎ ইংরেজিতে একে কোল্ডপ্রেস বলা হয়। যেহেতু বাদাম প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত উপাদান থেকে আসে, এজন্য এতে কোলেস্টেরল থাকেনা।আমরা প্রাণিজ উৎস থেকে যে সব তেল পাই, সেখানে কোলেস্টেলের পরিমাণ বেশি থাকে।এই বাদাম তেলে অন্যতম ভিটামিন ‘ই’থাকে।এই ভিটামিন ‘ই’শরীরের বিভিন্ন ধরনের ত্বক, চুল এবং আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোর সুস্থতার জন্য কাজ করে।বাদাম তেলে কারসোনচারিক উপাদান কম থাকায় ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায় এবং অন্যান্য ইনফ্লোমন্টারি ডিজিজগুলোও কম থাকে।বাদাম তেলের ব্যবহারটা আমরা গৃহস্থালিতে রান্নার কাজে বিশেষ করে ভাজা, খাদ্য প্রস্তুতির, পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল চিপস ভাজা অথবা বেকারী পণ্য তৈরীতেও ব্যবহার করতে পারি।

এত সব গুণাগুণের বিপরীতে বাদাম তেল নিয়ে কিছু অপকারিতার কথাও জানালেন ড. রুবেল মজুমদার।তিনি বলেন, আমরা বাদাম তেল দিয়ে রান্নার ক্ষেত্রে যদি বেশি তাপমাত্রা ব্যবহার করি, তাহলে তেল অক্সিডাইজড হয়ে ফ্রিরেডিক্যাল তৈরী হবে।আমরা উৎপাদন পর্যায়ে যখন জমি থেকে বাদাম নিয়ে আসি, তখন পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পানি বা আর্দ্রতার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মোল্ড জন্মাবে। ফলে আফলাটক্সিন তৈরী হবে। যেহেতু গৃহস্থালিতে রিফাইং প্রসেস কাজ করেনা, সেহেতু আফলাটক্সিন থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকেই যায়।
উদ্যোক্তা ও কারিগর:
গ্রামীণ নারীরা হস্তশিল্প, সেলাই, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও অনলাইন ভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে আয় রোজগার করেন, যা তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক:
নারীদের এই বহুমুখী অংশগ্রহণ পরিবার, সমাজ এবং জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে আরোও ত্বরান্বিত করে।
তাই গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাম না জানা বিথীর মতো অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছে যাদের সার্বিক সহযোগিতা সরকারকে এগিয়ে আসা সময়ের দাবি বলে মনে করেন অত্র এলাকার সচেতন মহল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
Theme Created By Limon Kabir