ভালোবাসা কখনো শুধু অনুভূতি নয় বরং এটা ত্যাগ, সাহস আর একে অপরের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গভীর প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতিকেই বাস্তবে রূপ দিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সাবেক শিক্ষিকা খাদিজা খাতুন। জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজের লিভারের ৬৪ শতাংশ দান করে স্বামী মোহাম্মদ আলম নুরীকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
এটা শুধু এক অঙ্গদানের ঘটনা নয়— বরং এক নারীর অবিচল ভালোবাসা, অগণিত বাধা পেরিয়ে স্বামীর জীবন রক্ষার এক অবিশ্বাস্য সংগ্রামের গল্প।
খাদিজা খাতুনের বাড়ি রাজশাহী শহরে, স্বামী আলম নুরীর বাড়ি বান্দরবানের লামায়। বর্তমানে তারা মিরপুরে বসবাস করেন। তাদের সংসারে কেএম আরিয়ান (৮) ও কেএম আদনান (৬) নামে দুই সন্তান রয়েছে।
শুরুটা হয় ২০১১ সালে আশুলিয়ায় বিএনসিসির সেন্ট্রাল ট্রেনিং এক্সারসাইজ ক্যাম্পে। আলম নুরী তখন নেভাল উইংয়ের ক্যাডেট সার্জেন্ট, আর খাদিজা ছিলেন মহাস্থান রেজিমেন্টের ক্যাডেট আন্ডার অফিসার। সেই পরিচয় থেকে জন্ম নেয় ভালোবাসা, যা ২০১২ সালে বিবাহে রূপ নেয়।
পরবর্তীতে আলম নুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ব্র্যাকে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন, পরে এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন। খাদিজা ২০১৫ সালে বিইউপিতে আইন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দাম্পত্য জীবনে প্রথম সন্তান আরিয়ান জন্ম নেয় ২০১৭ সালে, দ্বিতীয় সন্তান আদনান জন্ম নেন ২০১৯ সালে।
তবে সুখের সেই জীবন হঠাৎ থমকে যায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। কয়েক দিন জ্বরে ভুগে এক রাতে হঠাৎ আলমের রক্তবমি শুরু হয়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায় ভয়ংকর সত্য— আলম নন অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিসে আক্রান্ত, এবং লিভার সিরোসিস পৌঁছে গেছে শেষ পর্যায়ে। একমাত্র সমাধান— লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, যা সম্পন্ন করতে প্রয়োজন ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা।
খাদিজা থেমে থাকেননি। স্বামীর জীবন বাঁচাতে শুরু করেন এক দীর্ঘ সংগ্রাম। ভিসা, অর্থসংস্থান, ডোনার পরীক্ষা— সবকিছু নিজেই সামলান। নানা জটিলতা ও দেশের পরিস্থিতির কারণে ভারতে যেতে লাগে ছয় মাস। অবশেষে পরিবার, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় ২০২৫ সালের মার্চে তারা ভারতের দিল্লি যান, ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে।
সেখানে বিশ্বখ্যাত সার্জন ডা. সুভাষ গুপ্তার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শুরু হয়। একের পর এক পরীক্ষা শেষে নিশ্চিত হয়— খাদিজার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ, যা স্বামীর সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে। আইনি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সকল জটিলতা সমাধান হওয়ার পর ৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় অস্ত্রোপচার। খাদিজার লিভারের ৬৪ শতাংশ সফলভাবে আলমের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
১৩ ঘণ্টার দীর্ঘ অপারেশনের পর দুজনকেই আইসিইউতে নেওয়া হয়। খাদিজা পাঁচ দিন পর সুস্থ হয়ে ওয়ার্ডে ফিরেন, আর আলমের জ্ঞান ফেরে অপারেশনের পরদিন ভোরে। ১৫ দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর আলম ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ভারতে থাকার সময় খাদিজা নিজের পেটের ব্যথা ভুলে স্বামীর যত্নে দিনরাত ব্যস্ত ছিলেন। হাসপাতালের বাইরে নিজ হাতে রান্না করে প্রতিদিন আইসিইউতে পৌঁছে দিতেন। ধীরে ধীরে আলমের শরীরের প্রোটিন ঘাটতি পূরণ হয়।
এই চিকিৎসায় খরচ হয়েছে প্রায় ২১ লাখ রুপি, পাশাপাশি থাকা-খাওয়া ও পরবর্তী ওষুধে আরও প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ রুপি। বর্তমানে মাসে ৪০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায়।
২০২৫ সালের ২ অক্টোবর দেশে ফেরেন আলম ও খাদিজা। এখনো নিয়মিত ওষুধ, পর্যালোচনা ও কঠোর সতর্কতা তাদের জীবনের অংশ। তবে চোখে এখন কৃতজ্ঞতা— আল্লাহর প্রতি, পরিবার ও অসংখ্য অচেনা মানুষের প্রতি।
আলম নুরী বলেন, তার জীবনের দুটি জন্মদিন আছে— একটি মায়ের কোলের, আরেকটি স্ত্রীর লিভারে পাওয়া নতুন জীবন। দুই ছেলেকে নিয়ে খেলা, গল্প ও একসাথে থাকা এখন যেন স্বপ্নের মতো। “এ জীবন আমার নয়, আমার ভেতরের কলিজাটিও এখন আমার স্ত্রীর,” বলেন তিনি।
২০২৫ সালের ২ অক্টোবর দেশে ফেরেন আলম ও খাদিজা। এখনো নিয়মিত ওষুধ, পর্যালোচনা আর কঠোর সতর্কতা তাদের জীবনের অংশ। তবে তাদের চোখে এখন শুধু কৃতজ্ঞতা— আল্লাহর প্রতি, পরিবার ও অসংখ্য অচেনা মানুষের প্রতি।
এই লড়াইয়ে অসংখ্য মানুষ নীরবে পাশে থেকেছেন— পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শুভানুধ্যায়ী। সবাই মিলে গড়ে তুলেছেন এক মানবতার শৃঙ্খল, যা মৃত্যুকেও হার মানিয়েছে।
আজ আলম নুরী বলেন, তার জীবনের দুটি জন্মদিন— একটি মায়ের কোলের, আরেকটি স্ত্রীর লিভারে পাওয়া নতুন জীবনের। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে একসাথে খাওয়া, খেলা আর গল্প করা যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় তার কাছে। “এ জীবন আমার নয়, আমার ভেতরের কলিজাটিও এখন আমার স্ত্রীর,” বলেন তিনি।
সূত্র: ঢাকা পোস্ট