ভারতীয় মেইনস্ট্রিম সিনেমা মানেই তীব্র জাতীয়তাবাদী আস্ফালন। উগ্র হিন্দুত্ববাদের সাথে যেখানে থাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আরও প্রান্তিক করে তোলার প্রবণতা। মুসলমানদের এইসব সিনেমায় সচরাচর ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আর যদি কোনো মুসলিম চরিত্রকে ভালোভাবে উপস্থাপনও করা হয়, তাকেও সাজানো হয় ভারতীয় চাহিদামাফিক ধাঁচে। আর এসব সিনেমার পদে পদে ঘটে ইতিহাস বিকৃতি। যার প্রধান লক্ষ্য থাকে ভারতকে সাধু ও নায়ক অবতারে হাজির করা।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত রণবীর সিং অভিনীত বলিউডের স্পাই থ্রিলার ‘ধুরন্ধর’ও সেই ধারা থেকে বের হতে পারেনি। তাই ভারতে বেশ প্রশংসা পেলেও সিনেমাটি সমানভাবে সমালোচিত হচ্ছে পাকিস্তানে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ককে আরও জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে সিনেমাটি।
গত সপ্তাহে সিনেমা হলে মুক্তি পায় সাড়ে তিন ঘণ্টার এই ক্রস-বর্ডার রাজনৈতিক স্পাই ড্রামা ধুরন্ধর। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে গ্যাংস্টার এবং গোয়েন্দা এজেন্টদের সহিংস ও রক্তাক্ত জগতে দর্শকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। চলতি বছরের মে মাসে ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে বিদ্রোহীদের আক্রমণের পর সিনেমাটি হলে এলো। পেহেলগাম হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছিল। তবে ইসলামাবাদ এই ঘটনায় তাদের ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে, যার মধ্যে তিনটিই ছিল কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।
এই ছবিতে জনপ্রিয় অভিনেতা রণবীর সিং একজন ভারতীয় গুপ্তচরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তিনি পাকিস্তানের করাচিতে গ্যাংস্টার ও সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ করেন। সমালোচকদের দাবি, এই চলচ্চিত্রের গল্পে অতি-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারা রয়েছে। এটি ইতিহাসকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, যা বলিউডে একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা বলে তাঁরা মনে করেন।
ছবিটির পরিচালক আদিত্য ধর, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি গোপন অধ্যায়কে নাটকের রূপ দিয়েছেন। এটি ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র) পরিচালিত উচ্চ-স্তরের আন্তঃসীমান্ত অভিযানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মূল চরিত্রটি ভারতীয় জাতীয় সুরক্ষার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী নেটওয়ার্কগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে শত্রুর ভূমিতে অভিযান চালায়।
সিনেমাটি ভারতে বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্য পেলেও এটি বিতর্কের বাইরে থাকতে পারেনি। বিশেষ করে পাকিস্তানের করাচি এবং সেখানকার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা লিয়ারিকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে সেদেশে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নিদা কিরমানি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ছবিতে করাচির যে চিত্রায়ণ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ফ্যান্টাসি ভিত্তিক। এটি শহরটির অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও ভাষাকে ভুলভাবে তুলে ধরেছে। তিনি মনে করেন, এই সিনেমা শহরটিকে কেবল সহিংসতায় পর্যবসিত করেছে।
এদিকে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির সদস্য করাচির আদালতে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। যেখানে ২০০৭ সালে নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছবি অনুমতি ছাড়াই ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সাথে দলের নেতাদের সন্ত্রাসীদের সমর্থক হিসেবে চিত্রিত করার প্রতিবাদও জানানো হয়েছে। কিরমানি আরও উল্লেখ করেন, সিনেমাটির নির্মাতারা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে বেছে নিয়ে সেগুলিকে খুবই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী কাঠামোর মধ্যে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
ভারতের চলচ্চিত্র সমালোচক মায়াঙ্ক শেখর বলেন, সিনেমাটি যারা তৈরি করেছেন, তারা সম্ভবত করাচিতে কখনও পা রাখেননি। তিনি মনে করেন, হলিউড যেভাবে বাদামী তৃতীয় বিশ্বকে একটি নির্দিষ্ট সেপিয়া টোনে দেখায়; যেমনটা বাংলাদেশে সেট করা এক্সট্র্যাকশন ছবিতে দেখা গেছে। ধুরন্ধরও সেই ধারারই অনুসরণ করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বলিউডে এমন ধরনের গল্পের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সমালোচকরা মনে করেন, এই ধরনের সিনেমা ভারতের অভ্যন্তরে এবং সীমান্তের বাইরে থাকা মুসলিমদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে ভারতে মুসলিমরা আরও প্রান্তিক হয়ে ওঠেন।
যদিও নির্মাতারা সিনেমাটি সম্পূর্ণভাবে কল্পনার ভিত্তিতে তৈরি বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এর গল্পে ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণের বাস্তব-সময়ের অডিও রেকর্ডিং এবং সংবাদ ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। এটাকেও আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছেন সমালোচকরা।
সূত্র: আল জাজিরা